‘বাল্যবিবাহ নির্মূলে বাংলাদেশের লাগতে পারে ২১৫ বছর’
বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ শতাংশ হারে বাল্যবিবাহ কমছে। এই হারে কমলে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ দূর করতে সময় লাগবে ২১৫ বছর। আজ বুধবার বাল্যবিবাহ বন্ধে এক অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিস্টিন ব্লুখুস। অনুষ্ঠানে বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুসারে বাল্যবিবাহ নির্মূলে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে ২২ গুণ বাড়াতে হবে।
গতকাল মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ বন্ধে যৌথ বৈশ্বিক কর্মসূচির (জিপিইসিএম) তৃতীয় পর্যায়ের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব তথ্য উঠে আসে।
রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলা হয়, তৃতীয় পর্যায়ের কর্মসূচিতে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আইনি কাঠামো জোরদার করা, শিক্ষার হার বাড়ানো, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলোকে কাজে লাগানো এবং সামাজিক কিছু আচরণ পরিবর্তনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ প্রতিবেদনকে ভিত্তি করে বাল্যবিবাহ নির্মূলে ধীরগতির তথ্য তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ১৮ বছরের কম বয়সে বাল্যবিবাহের হার ২০০৬ সালে ৬৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ৫২ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৫১ শতাংশ ছিল। সেই হিসাবে দেশে এখন ৪ কোটি ১৫ লাখ মেয়ে ও নারী বিবাহিত এবং সন্তানের মা। গত ১০ বছরে বাল্যবিবাহ কমার যে হার দেখা যাচ্ছে, সে হার দ্বিগুণ হলেও ২০৩০ সালে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার হবে প্রায় ৩০ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে এ হার ১৫ শতাংশের নিচে নামবে।
অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা হাবের এক সদস্য কিশোরী সানজিদা ইসলাম (১৫) জানায়, গত বছর প্রতিবেশীদের কথায় প্রভাবিত হয়ে কীভাবে মা-বাবা তার বাল্যবিবাহ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হাবের কাউন্সেলরদের সহায়তায় তার মা-বাবা বাল্যবিবাহ দেওয়া থেকে সরে আসেন। সানজিদা বলে, ‘আমার অনেক স্বপ্ন আছে। আমি খেলতে ভালোবাসি। এখন আমি নিজের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যেতে পারব।’
বাল্যবিবাহ নিয়ে সচেতনতামূলক কাজে যুক্ত মাদ্রাসা ছাত্র মোহাম্মদ জায়েদ আমিন (১৬) বলে, তার বড় বোন জিপিএ-৫ পেয়ে মাধ্যমিক পাস করার পর প্রতিবেশীরা এভাবে বাল্যবিবাহের জন্য চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবা মেয়ের মতকে গুরুত্ব দিয়ে পড়াচ্ছেন। জায়েদের ভাষায়, ইসলাম নারীশিক্ষা ও নারীর উপার্জনকে হারাম করেছে বলে অপপ্রচার চালানো হয়। ইসলাম নারীর শিক্ষা ও অধিকারের ওপর জোর দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। এ হার আফগানিস্তানে ৩৫, ভারতে ২৭, পাকিস্তানে ২১, নেপালে ১০ ও শ্রীলঙ্কায় ৪ শতাংশ। ওই দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেসব দেশের স্বাস্থ্য জরিপের ২০২১ সালের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
বিবিএসের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল’ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার প্রায় ৪২ শতাংশ। ১৫ বছরের কম বয়সীদের বাল্যবিবাহের হার ৮ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন (রিমি) বলেন, বাল্যবিবাহ নির্মূল করা সরকারের অঙ্গীকার। তবে সরকারের একার পক্ষে বাল্যবিবাহ নির্মূল করা সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। একেক এলাকায় একেক রকম কারণে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি। বাল্যবিবাহ নির্মূলের লক্ষ্য পূরণের কাজে গতি আনতে হবে। বাল্যবিবাহ হচ্ছে জাতীয় সম্পদের অপচয়। মা-বাবাকে সচেতন করতে হবে যে মেয়ে মহামূল্যবান সম্পদ। মেয়ের শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে বহু গুণে তা পরিবার ও সমাজের কাজে ফেরত আসে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেয়া খান বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কিশোর-কিশোরী ক্লাব, উঠান বৈঠকসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিস্টিন ব্লুখুস বলেন, ২ শতাংশের কিছু বেশি হারে বাংলাদেশে প্রতিবছর বাল্যবিবাহ কমছে। এই গতিতে কমলে বাল্যবিবাহ নির্মূলে বাংলাদেশের সময় লাগবে ২১৫ বছর। প্রত্যেক মেয়ে অফুরান সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নেয়। এসব মেয়ের প্রতি যত্ন নিলে, তাদের স্কুলে মেয়েদের রাখা গেলে তারা বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিতে পারে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের ওআইসি প্রতিনিধি স্ট্যানলে জিওয়াভুয়ে বলেন, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ ধীরে হলেও কমছে। এটা সম্ভব হতো না যদি সরকার ও অংশীদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাল্যবিবাহ নির্মূলে কাজ না করত। তবে এ কাজে গতি আরও বাড়াতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে এ প্রচেষ্টাকে ২২ গুণ বাড়াতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক।