ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন গ্রামের মানুষ

বিদ্যুৎপ্রতীকী ছবি

দুই দফা দাবিতে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করছেন দেশের সব গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সমিতির ২০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন সমিতির কর্মচারীরা। এতে জেলায় জেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিলেন গ্রামের মানুষ। সারা দেশেও বিদ্যুৎ বন্ধের শঙ্কা তৈরি হয়।

আরইবির অধীন কাজ করে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। সমিতির কর্মকর্তা–কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। দেশের মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের ৫৫ শতাংশ আরইবির অধীন।

আরইবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি একীভূতকরণ এবং অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়নসহ চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিত কর্মচারীদের স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে মুক্তিকামী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৪৫ হাজার কর্মকর্তা–কর্মচারীর ব্যানারে এ আন্দোলন হচ্ছে।

আন্দোলনকারীদের পক্ষে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বলা হয়েছে, ২০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাঁদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরইবি চেয়ারম্যানের অপসারণ, চাকরি অবসায়নের আদেশ ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান তাঁরা। না হলে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করতে বাধ্য হবেন তাঁরা।

রাত সাড়ে নয়টায় আরইবির সদস্য (বিতরণ) দেবাশীষ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে সমিতির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। অচল পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছিল। তবে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সবার সহায়তায় সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়েছে।’

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকে চাকরিচ্যুতির খবর আসতে থাকে বিভিন্ন সমিতিতে। গতকাল সকালে নেত্রকোনা জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মনির হোসেনকে চাকরিচ্যুতির পর আটক করে বারহাট্টা থানায় নিয়ে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিছুক্ষণ পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই নেত্রকোনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন সমিতির কর্মচারীরা। এরপর একের পর এক জেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ হতে থাকে। বিকেলের দিকে আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন রাজন কুমার দাশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে সাদাপোশাকের লোকজন নিয়ে যান।

সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনের সংগঠকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। শিগগিরই তাঁদের সঙ্গে বসে ন্যায্য দাবির বিষয়ে আলোচনা হবে, এটি রোববারও হতে পারে। তাঁরা ইতিমধ্যে আন্দোলন স্থগিত করেছেন।

আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গতকাল ৩৩ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়। জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে নেত্রকোনা, ঢাকার আশপাশের উপজেলা, বরিশাল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, মুন্সিগঞ্জ, মাগুরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঝালকাঠি, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, বাগেরহাট, হবিগঞ্জ, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, কক্সবাজার, রাজবাড়ী, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, পাবনা, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর ও যশোর জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারীরা।

অবশ্য গতকাল রাত নয়টা পর্যন্ত প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ২০টি জেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার খবর পাওয়া গেছে।

জাতীয় গ্রিড নিয়ে ছিল শঙ্কা

সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সারা দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থাকে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি। বিদ্যুতের চাহিদা বুঝে বিভিন্ন কেন্দ্রকে উৎপাদনের নির্দেশ দেয় তারা। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। কোনো কারণে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ অনেক কম বা বেশি হলে গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে। গতকাল হঠাৎ কোনো ঘোষণা ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করায় চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেড়ে যায়। এতে সারা দেশ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই ভারসাম্য রাখতে দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দেয় পিজিসিবি। এ ছাড়া কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় বিদ্যুৎ সরবরাহ আবার চালু করা হয়। সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।

পিজিসিবি সূত্র বলছে, গতকাল বেলা তিনটার দিকে তারা সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এক ঘণ্টা পরই এটি ৯ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। আন্দোলনকারীরা বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার পর সন্ধ্যা সাতটায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ।

পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুল মোনায়েম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, সব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরিস্থিতি জানিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। গ্রিড বিপর্যয় ঠেকাতে দিনভর পিজিসিবির নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে নজরদারি করা হয়েছে। গ্রিড বিপর্যয় এড়াতে রাতেও বাড়তি জনবল থাকছে।

লাখো মানুষ ভোগান্তিতে

ময়মনসিংহ অঞ্চলে অন্তত ৩৭ লাখ গ্রাহক ভোগান্তির মধ্যে পড়েন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতা চালিয়ে বন্ধ হওয়া সংযোগ চালুর চেষ্টা করে। পিজিসিবি ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল হক বলেন, সকাল নয়টা থেকে নেত্রকোনায় বন্ধ থাকলেও বেলা দুইটা থেকে কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর এবং বেলা সাড়ে তিনটা থেকে ময়মনসিংহ জেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ করতে শুরু করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি।

বেলা সোয়া তিনটা থেকে রাজশাহীর নয়টি উপজেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ করা হয়। ওই সময় তানোর জোনাল সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামাল হোসেন জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা বিদ্যুৎ সরবরাহ করবেন না। দাবি আদায়ে প্রয়োজনে সারা দেশের কর্মীরা ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বেলা ১১টার দিকে মাগুরার পুরো জেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেন সমিতির কর্মকর্তা–কর্মচারীরা। পরে ছাত্রসমাজ ও গ্রাহকদের প্রতিবাদের মুখে বেলা দুইটায় আবার বিদ্যুৎ চালু করা হয়। সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কেরানীগঞ্জে বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে দেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ৪–এর কর্মীরা। পরে সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হয়।

সেনাবাহিনীর মেজর মো. রিফাত সাংবাদিকদের বলেন, দেশের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ বন্ধ থাকলে জনভোগান্তি ও জটিলতা সৃষ্টি হয়। জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে দাবি আদায়ের চেষ্টা সমীচীন নয়। তাঁদের যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবি আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।

বেলা সাড়ে তিনটা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করায় সিলেটের সাত উপজেলার প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েন। মুন্সিগঞ্জের পাঁচটি উপজেলায় বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে দেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মীরা।

কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। বেলা ১১টা থেকে বিভিন্ন সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। ঝালকাঠিতে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে দেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মীরা।

যশোরের কেশবপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করায় ৮৭ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট থেকে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়। ফলে গ্রাহকেরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। কেশবপুর জোনাল কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক এস এম শাহীন আহসান জানান, আন্দোলনের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে।

রোববার পর্যন্ত স্থগিত আন্দোলন

রাতে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, সরকারের আশ্বাসে বিদ্যুৎ চালুর পরও তাঁদের চারজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় আটক করা হচ্ছে।

আন্দোলনের সমন্বয়ক আবদুল হাকিম রাত সাড়ে আটটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, আটক ব্যক্তিদের সকালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আন্দোলন রোববার পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। তবে চাকরিচ্যুতির আদেশ ও মামলা প্রত্যাহার এবং কর্মকর্তাদের মুক্তির দাবি মানা না হলে নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা]