ব্রিগেডিয়ার (অব.) জেড এ খান
যে রাতে মুজিব বন্দী হলেন
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির ভিত্তি। গত ২৫ বছরে প্রথম আলো বিচিত্র বিষয়ে ও মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছে। উদ্ধার করেছে দেশি–বিদেশি অজানা তথ্য ও দলিল, সংগ্রহ করেছে ঘটনার নায়ক থেকে সাধারণ মানুষদের অভিজ্ঞতা, প্রকাশ করেছে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচয়, ছাপিয়েছে কুশীলব ও গবেষকদের লেখা। প্রথম আলোর মহাফেজখানা থেকে থাকল বাছাই লেখা।
মার্চ মাসের ২৩ তারিখের দুপুরে আমাকে জানানো হলো, গ্যারিসনের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিয়ে একটা সি-১৩০ বিমান কুমিল্লা বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। ঢাকায় এক রাত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে ইউনিফর্ম পাল্টে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আমার স্ত্রী বলল, আমি যেন আমার অফিসের সেফে রাখা ওর গয়নাগুলো ওকে দিয়ে যাই। সেদিন সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবের পার্টিতে ওগুলো পরে যাবে ও। আমাদের ঘরে গয়না রাখার মতো কোনো নিরাপদ জায়গা ছিল না। কুমিল্লার ব্যাংকগুলোতেও লকার ছিল না কোনো। আমি গয়নাগুলো এনে দিই ওকে। পরের ঘটনাবলি যেভাবে ঘটেছিল, ভাগ্যিস এনে দিয়েছিলাম ওগুলো।
এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার পথে একটা ন্যাংটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার জিপটা দেখে ছেলেটা হিংস্রভাবে চিৎকার করে ওঠে, ‘জয় বাংলা’। আমার আড়াই বছরের মেয়েটাকেও দেখতাম ‘জয় বাংলা’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির চারপাশে দৌড়াদৌড়ি করত; ওর বড় বোন চাইত ওকে বাধা দিতে।
‘সাধারণ ধর্মঘট’ শুরু হওয়ার পর আমার ব্যাটালিয়ন থেকে হামজা কোম্পানির একটা প্লাটুন নিয়ে কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সি-১৩০ বিমানটা কুমিল্লা গ্যারিসনের জন্য রেশন নিয়ে এসেছিল। টিনের দুধ, চিনি ইত্যাদি নামানোর কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওটা টেক–অফ করে। বিমানটার পাইলট ছিল স্কোয়াড্রন লিডার আবদুল মুনিম খান, আমার ছোট ভাই স্কোয়াড্রন লিডার শোয়েব আলমের ভায়রা (শ্যালকও হতে পরে—অনুবাদক)। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে করতে ঢাকায় পৌঁছে যাই।
সেদিন ২৩ মার্চ, পাকিস্তান দিবস ছিল বিধায় সব ভবনশীর্ষে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ার কথা। আমরা যখন ঢাকার ওপর দিয়ে উড়ছিলাম, দেখি সারা শহরে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা।
মুজিব এ সময় আমাকে বলেন, তিনি ভুলে পাইপ ফেলে এসেছেন। আমি আবার তাঁর সঙ্গে ফিরে আসি। পাইপ নিয়ে নেন তিনি। এর মধ্যে শেখ মুজিব নিশ্চিত হয়ে গেছেন, আমরা তাঁকে হত্যা করব না। তিনি বলেন, আমরা তাঁকে ডাকলেই হতো, তিনি নিজে থেকেই বেরিয়ে আসতেন।
মেজর বিলালকে জানানো হয়েছিল, সি-১৩০ বিমানটিতে করে আমি যাব। তাই ও এয়ারপোর্টে গিয়ে আমাকে রিসিভ করে। এয়ারপোর্ট থেকে অফিসার্স মেসে যাওয়ার পথে ও আমাকে বলে, ওর প্রতি নির্দেশ আছে, যাতে আমাকে মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারের কর্নেল এস ডি আহমদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল বিধায় আমরা অফিসার্স মেসে কর্নেলের রুমে চলে যাই। তিনি আমাকে বললেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পরদিন অথবা তার পরদিন গ্রেপ্তার করতে হবে। আমি যেন প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা তৈরি করি। তিনি আমাকে আরও বললেন, ইউনাইটেড ব্যাংকের জোনাল ম্যানেজার দুটো গাড়ি আমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন, যাতে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান, জরিপ ইত্যাদি কাজ সেরে নিতে পারি আমি।
শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার আনুষ্ঠানিক আদেশের জন্য আমাকে ২৪ মার্চ বেলা ১১টায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি জেনারেলের অফিসে গেলে তিনি আমাকে বলেন, পরের রাতে মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তাঁর নির্দেশ শুনে স্যালুট করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে থামালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কাজটা কীভাবে করতে হবে, সেটা শুনতে চাও না? আমি তাঁকে বলি, কীভাবে কোনো একটা নির্দেশ পালন করতে হবে, সেটা বলে দেওয়ার রেওয়াজ নেই, তবে তার মনে যেহেতু কিছু একটা আছে, তিনি তা বলতে পারেন। তখন তিনি বললেন, আমি একটা বেসামরিক গাড়িতে একজন মাত্র অফিসার নিয়ে যেতে পারব এবং সেভাবেই শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করতে হবে। আমি বলি, বাড়ির চারপাশে যে পরিমাণ ভিড় থাকে, তাতে এক কোম্পানির কমে কাজটা করা সম্ভব হবে না। তিনি তখন বললেন, এটা তাঁর নির্দেশ এবং তিনি যেভাবে বলেছেন, নির্দেশটা সেভাবেই পালন করতে হবে। আমি তখন তাঁকে বলি, তাঁর আদেশ আমি গ্রহণ করছি না এবং কাজটা করার জন্য তিনি যেন অন্য কাউকে দায়িত্ব দেন। তারপর তিনি কিছু বলার আগে স্যালুট করে তাঁর অফিস থেকে বেরিয়ে আসি আমি।
বুঝতে পারি বিপদে পড়েছি। দিনের বাকি সময়টা আমি এমন কোথাও যাই না, যেখানে আমার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে পারে। এ সময় খবর পেলাম মেজর জেনারেল এ ও মিটঠা পিআইএর এক ফ্লাইটে ঢাকা আসছেন; বিকেল ৫টায় তাঁর পৌঁছার কথা। ফ্লাইট যখন পৌঁছে আমি তখন এয়ারফিল্ডে অপেক্ষমাণ। তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমার ওপর নির্দেশের কথা তাঁকে বলি এবং এটাও জানাই যে বাড়িটার সামনে সমবেত জনতার কারণে কেবল একটা গাড়ি চালিয়ে গিয়ে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব নয়। জেনারেল ৯টার সময় আমাকে ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
পরদিন সকাল ৯টা বাজার আগেই আমি ইস্টার্ন কমান্ডে কর্নেল আকবরের (পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার) অফিসে যাই। ঢুকেই দেখি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী সেখানে বসা। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে কেন গিয়েছি আমি। আমি জানাই, মেজর জেনারেল মিটঠার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। তিনি তখন কর্নেল আকবরকে নির্দেশ দেন যাতে একটা হেলিকপ্টার জোগাড় করে ১৫ মিনিটের মধ্যে আমাকে ঢাকা থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কর্নেল আকবর একবার আমার দিকে আর একবার জেনারেলের দিকে তাকান। তারপর আর্মি এভিয়েশন বেশে টেলিফোন করেন। ফোনে আলাপ শেষ করে বলেন, হেলিকপ্টার তৈরি হতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। আমি কর্নেল আকবরকে জিজ্ঞেস করি, মেজর জেনারেল মিটঠা এসেছেন কি না কিংবা আসার কথা আছে কি না। তিনি বলেন, জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কার রুমে আছেন। আমি তখন শরীরটা এমনভাবে ঘুরিয়ে বসলাম, যাতে জেনারেল টিক্কার অফিসে ঢোকার দরজাটা দেখা যায়। অস্বস্তিকর ১৫টা মিনিট কেটে যায়। এমন সময় দরজাটা খোলে এবং জেনালের মিটঠা বেরিয়ে আসেন। আমি একলাফে কর্নেল আকবরের অফিস থেকে বেরিয় এসে জেনারেলকে ধরি এবং কী ঘটেছে তাঁকে জানাই। জেনারেল স্টাফ কার দাঁড়িয়েছিল ওখানে, তিনি আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন। আমরা জেনারেল আবদুল হামিদ খানের বাসার দিকে রওনা হই।
জেনারেল হামিদের বাসার এক ওয়েটিং রুমে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর আমাকে ভেতরে ডেকে নেওয়া হয়। মেজর জেনারেল মিটঠা আমাকে বলেন, আমি তাঁকে যা বলেছি, সেসব যাতে জেনারেল হামিদকে খুলে বলি। জেনারেল হামিদ আমার কথা শোনেন, তারপর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে টেলিফোন করে বলেন যে আমাকে তাঁর কাছে পাঠাচ্ছেন তিনি এবং আমার যা যা প্রয়োজন, সব যাতে মেটানো হয়। আর আমাকে তিনি বলেন, শেখ মুজিবকে আমাকেই গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তাঁকে যাতে জীবিত রাখা হয়।
আমি তখন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর অফিসে যাই। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমার কী কী জিনিস লাগবে। আমি বলি, তিনটা সেনা বহনকারী গাড়ি এবং বাড়িটার একটা নকশা দরকার আমার। তার কাছে বাড়িটার নকশা ছিল। সেটা আমাকে দিলেন এবং বললেন, গাড়ির ব্যবস্থাও হবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি এবং সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থার একটা মডেল তৈরি করা হলো: ইস্যু করা হলো গোলাবারুদ। রাতের খাবারের পর আমি আমার কোম্পানিকে ব্রিফ করলাম। কোম্পানিকে তিনটা দলে ভাগ করি আমি। ক্যাপ্টেন সাঈদের নেতৃত্বে ২৫ জনের একটা দল শেখ মুজিবের বাড়ি ঘেরাও করবে। মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়ক থেকে গলিটা যেখানে ঢুকেছে, সেখানটা বন্ধ করে দিতে হবে। দ্বিতীয় রোড ব্লকটা হবে প্রথম ডান দিকের মোড়ে। তৃতীয়টা হবে দ্বিতীয় ডান মোড়ে। আরেকটা আবার মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়কে।
আমাদের মিলিত হওয়ার স্থান ঠিক হলো এমএনএ হোস্টেলের দিকে এয়ারফিল্ডের গেটে। আর রাস্তা হবে এয়ারফিল্ড, জাতীয় পরিষদ ভবন, মোহাম্মদপুর হয়ে ধানমন্ডি। আমার জিপ পুরো হেডলাইট জ্বালিয়ে সামনে থাকবে। ক্যাপ্টেন সাঈদ, ক্যাপ্টেন হুমায়ূন আর মেজর বিলাল বাতি না জ্বেলে তাদের ট্রাক নিয়ে আমাকে অনুসরণ করবে—এটার উদ্দেশ্য ছিল হেডলাইটের দিকে তাকিয়ে যাতে কেউ আন্দাজ করতে না পারে পেছনে কয়টা গাড়ি আছে। আমাকে বলা হয়েছিল অপারেশনটা শুরু করতে হবে মাঝরাতে। আর একটা পাসওয়ার্ড (সাংকেতিক শব্দ) দেওয়া হয়েছিল, যেটা পুরো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য।
অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে বিস্তারিত পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলা হলো। তারপর পুরো কোম্পানি এয়ারফিল্ডে গিয়ে বের হওয়ার গেটের কাছে জড়ো হয়। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে বেসামরিক পোশাকে ওর দলের দুজনসহ বেসামরিক গাড়িতে পাঠানো হলো একটা চক্কর দিয়ে শেখের বাড়ির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসতে।
রাত প্রায় ৯টার দিকে আমি এয়ারফিল্ডের দিকে যাই। রাত প্রায় ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন হুমায়ুন শেখ মুজিবের বাড়ির চারপাশ রেকি করে এসে রিপোর্ট করে, মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়কে প্রতিবন্ধক তৈরির কাজ চলছে। কোম্পানির সব কটি রকেট লঞ্চার নিয়ে আসতে নির্দেশ দেই আমি। প্রত্যেকটির সঙ্গে দুই রাউন্ড গোলা। রকেট লঞ্চারধারী সৈনিকদের ক্যাপ্টেন সাঈদের দলের সঙ্গে থাকতে বলা হলো। এ দলকে নির্দেশ দেওয়া হলো রোড ব্লকের মুখোমুখি হলে সৈনিকেরা এক লাইনে এগোবে, মাঝে থাকবে রকেট লঞ্চারধারী, প্রথমে রকেট ছোড়া হবে, তারপর সব কটি রাইফেল একসঙ্গে। আমি ব্যাখ্যা করে বলি যে ব্যারিকেডের আশপাশের জনতা আগে কখনোই রকেট লঞ্চার থেকে গোলা ছোড়া এবং বিস্ফোরণের দ্বৈত আওয়াজ শোনেনি। তাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। অন্য একটা দলকে রাস্তার দুপাশে লক্ষ রাখতে বলি আমি। রাস্তায় তৈরি প্রতিবন্ধক মজবুত করার সময় কমিয়ে দেওয়ার জন্য নিজ উদ্যোগে অপারেশন শুরু করার সময় মধ্যরাত থেকে এগিয়ে রাত ১১টা নির্ধারণ করেছিলাম।
২৫ মার্চ রাত ১১টায় আমরা এয়ারফিল্ড থেকে বের হয়ে এমএনএ হোস্টেল থেকে মোহাম্মদপুর অভিমুখী রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই। রাস্তার বাতি ছিল নেভানো, সমস্ত বিল্ডিং অন্ধকার, আমার জিপের হেডলাইট পুরো জ্বালানো, সিগন্যাল কোরের কাছ থেকে নেওয়া সেনাবাহী গাড়িগুলো বাতি নিভিয়ে আমার জিপের পেছন পেছন আসছিল। ঘণ্টায় প্রায় ২০ মাইল বেগে কনভয়টা মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়কের ওপর বামে মোড় নেয়। ধানমন্ডি থেকে প্রায় সিকি মাইল আগে রাস্তার ওপর কাত করে ফেলে রাখা ট্রাক এবং অন্যান্য গাড়ি রেখে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ মোতাবেক ক্যাপ্টেন সাঈদের দল লাইন করে দাঁড়ায়। প্রথমে রকেট নিক্ষেপ করে, তারপর রাইফেল থেকে গুলি করা শুরু করে; রাস্তার পাশের দলগুলোও গুলি করতে থাকে। দু-তিন মিনিট পর আমি গুলি বন্ধ করার আদেশ দিলাম। কিন্তু দেখলাম, সে আদেশ মানা হচ্ছে না। তাই আমাকে জনে জনে গিয়ে গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে হয়। ব্যারিকেড তৈরিতে ব্যবহৃত গাড়িগুলোয় আগুন ধরে যায়। একটা সাদা ভক্সওয়াগন কম্বি দেখলাম দাউ দাউ করে জ্বলছে, ব্যারিকেড বহাল রইল। তবে ওটা রক্ষা করার জন্য যারা ছিল, সব ততক্ষণে উধাও। ব্যারিকেডের মাঝখান দিয়ে কীভাবে একটা ফাঁক সৃষ্টি করা যায়, সেটা ভাবছিলাম আমি।
প্রায় ২০০ গজ এগোনোর পর আরেকটা রোড ব্লকের সম্মুখীন হলাম আমরা। এবার প্রায় দুই ফুট ব্যাসের পাইপ, ওগুলোর দৈর্ঘ্য দুপাশের উঁচু দেয়ালের মধ্যবর্তী রাস্তার পুরোটাই বন্ধ করে রেখেছে। আমরা উইঞ্চের মোটা ধাতব রশি পাইপের মাঝবরাবর বেঁধে টান লাগাই। এতে পুরো বন্ধকটা গড়িয়ে সরে আসে, কিন্তু রাস্তা জুড়ে থাকে একইভাবে। তখন উইঞ্চ কেব্ল বাঁধা হলো পাইপের এক মাথায় আর ক্যাপ্টেন সাঈদের লোকজনকে অন্য মাথায় বসিয়ে টান দেওয়া হলো।
আমরা আর শ–দুয়েক গজ গেলে আরেকটা প্রতিবন্ধক পথে পড়ে। এটি প্রায় তিন ফুট উঁচু আর চার ফুট প্রশস্ত করে জড়ো করা ইট দিয়ে তৈরি। আমরা ট্রুপস ক্যারিয়ার দিয়ে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির জন্য রাস্তা তৈরি করে নিতে চাইলাম। কিন্তু সম্ভব হয় না। তখন ক্যাপ্টেন সাঈদের দলকে নির্দেশ দিলাম যাতে হাতে হাতে ইট সরিয়ে গাড়ি বের হয়ে যাওয়ার মতো প্রশস্ত পথ তৈরি করে নেয়। বাহিনীর বাকি সদস্যদের বললাম গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে রওনা হওয়ার জন্য।
আমরা মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি সড়ক ধরে হেঁটে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে অগ্রসর হই। তারপর লেক এবং সে বাড়ির মধ্যবর্তী গলিতে ঢোকার জন্য ডানে মোড় নিই। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের বাহিনী শেখ মুজিবের বাড়ির পাশের বাড়ি ঢুকে ছুটে গিয়ে দেয়াল টপকে সে বাড়িতে প্রবেশ করে। গুলিবর্ষণ করা হয়, কম্পাউন্ডের ভেতর থেকে কিছু লোক গেট পেরিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়, একজন মারা যায়। বাড়ির বাইরে পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের প্রহরী দল তাদের ১৮০ পাউন্ডার তাঁবুতে ঢুকে খুঁটিসমেত তাঁবু উঠিয়ে নিয়ে লেকের দিকে পালিয়ে যায়। শেখ মুজিবের সীমানাদেয়াল নিরাপদ করা হলো, আলকাতরার মতো অন্ধকার চারপাশে, মুজিবের বাড়ি এবং আশপাশের বাড়িতে কোনো বাতি নেই।
তখন সার্চ পার্টি বাড়িটাতে ঢোকে। শেখ মুজিবের এক প্রহরীকে নিয়ে একজন সৈনিক পাশে পাশে হেঁটে আসছিল। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে যাওয়ার পর সেই প্রহরী একটা দা, লম্বা ফলাওয়ালা ছুরি বের করে সৈনিকটিকে আক্রমণ করে। সে জানত না পেছন থেকে ওকে কভার দেওয়া হচ্ছে। ওকে গুলি করা হয়, তবে মেরে ফেলা হয়নি। নিচতলা সার্চ করা হয় কিন্তু কাউকে পাওয়া যায় না। অনুসন্ধানী দল ওপরতলায় যায়। যেসব কামরা খোলা ওখানে কাউকে পাওয়া গেল না। একটা কামরা ভেতর থেকে আটকানো। আমি ওপরতলায় গেলে একজন আমাকে বলে, বন্ধ কামরাটার ভেতর থেকে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমি মেজর বিলালকে বন্ধ কামরাটার দরজা ভেঙে ফেলতে বলে ক্যাপ্টেন সাঈদ এসেছে কি না এবং অন্য কোনো লোকজন জড়ো হয়েছে কি না দেখার জন্য নিচতলায় নেমে আসি।
বাইরে বেরিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় নেমে দেখি, ক্যাপ্টেন সাঈদ ওর বাহনগুলো নিয়ে এসে পৌঁছে গেছে। তবে পাঁচটনি গাড়িগুলো ঘোরানোর সময় সরু রাস্তায় একটাকে আটকে ফেলেছে। আমার জিপের ওয়্যারলেসের লাউড স্পিকারে শুনতে পাই ব্রিগেডিয়ার জাহানজের আরবার, পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, তাঁর ইউনিটগুলোর একটিকে তাদের ‘রোমিও রোমিওগুলো’ (রিকয়েললেস রাইফেল— অনুবাদক) ব্যবহার করার জন্য তাড়া দিচ্ছেন।
আমি যখন ক্যাপ্টেন সাঈদকে গাড়িগুলো কীভাবে লাইন করতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছিলাম, তখন প্রথমে একটা গুলির শব্দ, তারপর গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং শেষে সাবমেশিনগান থেকে ব্রাশফায়ারের আওয়াজ শুনতে পাই। ভাবলাম, কেউ বুঝি শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। আমি ছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকে ওপরতলায় গিয়ে যে ঘরটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সেটার দরজার সামনে কম্পিত অবস্থায় শেখ মুজিবকে দেখতে পাই। আমি তাঁকে আমার সঙ্গে যেতে বলি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারবেন কি না। আমি অনুমতি দিই। তিনি কামরাটার ভেতর গেলেন। সেখানে তাঁর পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে আসেন। আমরা গাড়িগুলো যেখানে, সেদিকে হাঁটতে থাকি। ক্যাপ্টেন সাঈদ তখনো ওর গাড়িগুলো ঘোরাতে সক্ষম হয়নি। আমি ইস্টার্ন কমান্ডে একটা রেডিওবার্তা পাঠাই যে শেখ মুজিবকে ধরা গেছে।
মুজিব এ সময় আমাকে বলেন, তিনি ভুলে পাইপ ফেলে এসেছেন। আমি আবার তাঁর সঙ্গে ফিরে আসি। পাইপ নিয়ে নেন তিনি। এর মধ্যে শেখ মুজিব নিশ্চিত হয়ে গেছেন, আমরা তাঁকে হত্যা করব না। তিনি বলেন, আমরা তাঁকে ডাকলেই হতো, তিনি নিজে থেকেই বেরিয়ে আসতেন। আমি তাঁকে বলি, আমরা তাঁকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে ওঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। আমরা ফিরে আসতে আসতে ক্যাপ্টেন সাঈদ ওর গাড়িগুলো লাইন করে ফেলে। শেখ মুজিবকে মাঝে সেনাবাহী গাড়িতে ওঠানো হয়। আমরা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাত্রা করি।
আমি পরে জানতে পারি মেজর বিলালকে ওপরতলার বন্ধ রুমের দরজাটা ভাঙার জন্য বলে আমি গাড়ির অবস্থা দেখার জন্য যখন নিচে নেমে আসি, কেউ একজন ওর সৈন্যরা যেখানে জড়ো হয়েছিল, সেদিক লক্ষ্য করে একটা পিস্তল দিয়ে গুলি করে। ভাগ্যক্রমে কেউ আঘাত পায়নি। কেউ থামানোর আগেই ওর এক সৈনিক বারান্দার যেদিক থেকে পিস্তলের গুলি এসেছিল, সেদিকে একটা গ্রেনেড ছুড়ে মারে। তারপর সাবমেশিনগান থেকে একপশলা গুলি গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং সাবমেশিনগানের শব্দে শেখ মুজিব বন্ধ কামরার ভেতর থেকে ডাক দিয়ে বলেন, যদি তাঁকে হত্যা করা হবে না—এই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তাহলে তিনি বেরিয়ে আসবেন। তাঁকে নিশ্চিত করা হয়। তখন তিনি বেরিয়ে আসেন। তিনি বের হয়ে আসার পর হাবিলদার মেজর খান ওয়াজির, পরবর্তী সময়ে সুবেদার, তাঁর গালে একটা সশব্দ চড় মেরেছিল।
আমার ওপর আদেশ ছিল শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করার। কিন্তু তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে কিংবা কার কাছে হস্তান্তর করতে হবে, সেসব কিছুই বলা হয়নি। আমরা ফিরে যাওয়ার সময় আমি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি। শেষে ঠিক করলাম ওঁকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভবনে নিযে গিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ওখানেই রেখে দেব। আমি জাতীয় পরিষদ ভবনের সামনে গিয়ে থামি। তারপর জিপের একটা সিট খুলে নিয়ে মুজিবকেসহ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাই। সেখানে ল্যান্ডংয়ে বসাই তাঁকে। আমরা যখন এসব করছিলাম, তখন ফার্মগেটের দিকে হাজার হাজার লোকের ছোটার শব্দ পেলাম। আমরা ভাবি, ওরা আমাদের দিকে আসছে। তাই নিজেদের রক্ষার জন্য প্রস্তুত হই আমরা। কিছুক্ষণ পর শব্দটা মিলিয়ে যায়।
জাতীয় পরিষদ ভবন থেকে আমি মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারে যাই। লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ওখানে তাঁর প্রধান দপ্তর বানিয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার গোলাম জিলানি খানের সঙ্গে দেখা করলাম আমি। তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁকে জানালাম, শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ে রেখে এসেছি। তিনি আমাকে লেফটেন্যানন্ট জেনালে টিক্কা খানের অফিসে ঢোকার মুখ পর্যন্ত নিয়ে যান। তারপর ভেতরে গিয়ে জেনারেলের কাছে রিপোর্ট করতে বলেন। জেনারেল টিক্কা নিশ্চয়ই জেনেছেন শেখ মুজিবকে বন্দী করা হয়েছে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—এই মর্মে আমার আনুষ্ঠানিক খবরটার জন্য খুব শান্ত হয়ে বসে তিনি অপেক্ষা করছিলেন। একটু মজা করার জন্য আমি তাঁকে বলি, একজন লোককে গ্রেপ্তার করেছি, যিনি দেখতে মুজিবের মতো; আমার মনে হয় এ লোকটাই মুজিব। তবে আমি নিশ্চিত নই। এটা শোনামাত্র জেনারেল টিক্কা বাক্সের ভেতর স্প্রিং লাগানো পুতুলের মতো তাঁর চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তারপর ব্রিগেডিয়ার জিলানিকে ডাক দেন। তিনি অফিসে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলে আমি কী বলেছি তা শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি এক্ষুনি ব্যাপারটা দেখছেন বলে কমান্ডারকে আশ্বস্ত করেন। কর্নেল এস ডি আহমদকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে জাতীয় পরিষদ ভবনে গিয়ে দেখে আসতে বলা হলো আমি আসল না নকল শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছি।
কর্নেল এস ডি আহমদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সিগারেট খাওয়ার জন্য আমি অফিস বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে দাঁড়াই। আমি যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম, হেডকোয়ার্টারের সীমানার কাঁটাতারের কাছে বসানো একটা হালকা মেশিনগান থেকে একপশলা গুলি বর্ষিত হয়। ওটা দুর্ঘটনাবশতও হতে পারে অথবা গানার কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল। গুলিবর্ষণের পর কিছুক্ষণের জন্য আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। তারপর ক্যান্টনমেন্টের এবং শহরের সব কটি অস্ত্র একসঙ্গে গুলিবর্ষণ শুরু করে। অন্যদের থেকে পিছিয়ে না থাকার জন্য এয়ারফিল্ডের এন্ট্রি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্টও গোলাবর্ষণ করে। সবুজ আর হলুদ আলোর ধনুকাকৃতির রেখা পুরো ঢাকা শহরের ওপর আঁকিবুঁকি করতে থাকে। কয়েক মিনিট পর যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবে হঠাৎ সব থেমে যায়।
প্রায় মিনিট বিশেক পর কর্নেল এস ডি আহমদ ফিরে এসে নিশ্চিত করে, আমি আসল শেখ মুজিবকেই গ্রেপ্তার করেছি। তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে হবে, এ কথা জিজ্ঞেস করলে তাঁরা একত্রে সলাপরামর্শ করতে থাকেন । কারণ, আগে এরা এ বিষয়ে কিছুতেই ভাবেননি। সবশেষে ঠিক হয় যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে যে কামরায় রাখা হয়েছিল, সে কামরাতেই রাখা হবে। আমরা তাঁকে ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসে নিয়ে যাই। তাঁকে একটা আলাদা এক শয্যার কক্ষে রাখা হয়, সঙ্গে একজন গার্ড দেওয়া হয়। পরদিন মেজর জেনারেল মিটঠা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হয়েছে। কোথায় রেখেছি বললে তিনি খুব বিরক্ত হলেন। বলেন, পরিস্থিতি বুঝতে পারার মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে এ ব্যাপারে। তাঁকে মুক্ত করার একটা চেষ্টা চালানো হতে পারে। তিনি পরে শেখ মুজিবকে একটা স্কুল বিল্ডিংয়ের তিনতলায় স্থানান্তরের নির্দেশ দেন।
মার্চ ১৯৭১-এ যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকে মনে করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই পূর্ব পাকিস্তানকে হারাতে হয়েছিল। এটা মনে করা হয় যে অ্যাডমিরাল আহসান পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ, তিনি সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে সম্মত ছিলেন না। বলা হয়ে থাকে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান সামরিক ব্যবস্থার পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বলা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং পদত্যাগ করেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুবের অস্বীকার, তাঁর উত্তরসূরি খুঁজে নিতে জেনারেল ইয়াহিয়ার বিলম্ব এবং ১৮ দিন ধরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া ইত্যাদি আওয়ামী লীগকে সুযোগ করে দিয়েছিল জনগণের কাছে দেখাতে যে তারা সেনাবাহিনী এবং সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষকে অকেজো করে দিয়েছে। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গৃহীত পরবর্তী ব্যবস্থা প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগও করে দেওয়া হয়েছিল এতে করে।
(সংক্ষেপিত)
প্রথম আলো, ২৫ মার্চ ২০০২
অনুবাদ: ফারুক মঈনউদ্দীন