বিটিসিএলের দরপত্র
আসল জালিয়াতি ঢাকতে কাল্পনিক শাস্তির সুপারিশ
চার বছরেও প্রকল্পটি হয়নি, সরকার শতকোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত।
বিটিসিএলের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ।
বিদেশি কলের আদান-প্রদান এবং দ্রুতগতির ডেটা ও ইন্টারনেট চাহিদা পূরণের জন্য বিটিসিএলের মাধ্যমে চার বছর আগে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। কিন্তু কর্তৃপক্ষের পছন্দের প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় শেষ মুহূর্তে দরপত্র বাতিল করে। সেটি করতে গিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে মূল্যায়ন কমিটির মতামত পাল্টে দেয় কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তী সময়ে সেই জালিয়াতি চাপা দিতে প্রকৃত অভিযোগ পাশ কাটিয়ে কাল্পনিক অভিযোগে শাস্তির সুপারিশ করেছে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) রিভিউ প্যানেল। এসব জালিয়াতি ও দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে।
এদিকে একের পর এক দরপত্র, পুনঃদরপত্রের চক্করে পড়ে শেষ পর্যন্ত ওই প্রকল্পের কাজ আর হয়নি। এর ফলে প্রকল্পের সুবিধা এবং প্রায় শতকোটি টাকার রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে জালিয়াতির মাধ্যমে দরপত্র বাতিল, সেটা চাপা দিতে রিভিউ প্যানেলের কারসাজির বিষয়টি এসেছে দুদকের অনুসন্ধানে।
দুদকের অনুসন্ধানে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন (এসটিএন) প্রকল্পে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল মতিন, তিন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম, এ কে এম হাবিবুর রহমান ও খন্দকার যুবায়ের হাসান, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের উপসচিব (ডাক-২) এ বি এম বদিউজ্জামানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালজালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ তুলে ধরে অনুসন্ধান প্রতিবেদন সম্প্রতি দাখিল করা হয়েছে। কমিশনের অনুমোদন পেলেই মামলা দায়ের হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত পাঁচ ব্যক্তির বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাঁদের মধ্যে খন্দকার যুবায়ের হাসান দাবি করেন, ‘কম খরচে যন্ত্রপাতি কিনে সরকারি খরচ বাচাতে আমরা আবার দরপত্র আহ্বানের পক্ষে মত দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো জালজালিয়াতির বিষয় আমার জানা নেই।’ বাকি চারজনের বক্তব্য জানতে গত দুই সপ্তাহে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়। তাঁদের মুঠোফোনে কল এবং খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হয়। কিন্তু তাঁরা সাড়া দেননি।
বিটিসিএল নথিপত্র অনুযায়ী, ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন বিটিসিএলের মাধ্যমে ৪০ লাখ ১৮ হাজার ডলারের (তখন ১ ডলার= ৮৪.৯৫ টাকা ছিল; সেই হিসাবে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা) প্রকল্প নেয় সরকার। ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। একই বছরের ২৭ নভেম্বর প্রকল্পের প্রাক্কলন সিলগালা খামে পেয়ে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিজে তা অনুমোদন করে সিলগালা করে রাখেন। এরপর ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। সাত সদ্যস্যের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সর্বসম্মতিক্রমে এক্স-ফার নামের দেশি প্রতিষ্ঠানকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য হিসেবে নির্বাচিত করে। এরপর কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশসহ ছাপাকৃত প্রতিবেদনে মূল্যায়ন কমিটির সদস্যসচিব প্রকল্প পরিচালক এবং দুই বহিঃসদস্য সই করেন।
কিন্তু কমিটিতে থাকা বিটিসিএলসহ সরকারি চার কর্মকর্তা মূল্যায়ন প্রতিবেদনের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা নম্বর হাতে কেটে পুনঃদরপত্র আহ্বানের ভিন্নমত সংবলিত দুটি পাতা সংযোজন করেন। এতে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মূল প্রতিবেদনের মতামত পুরো উল্টে দেন।
এই জালিয়াতি গোপন করতে বিটিসিএলের পর্ষদ সভায় মূল্যায়ন প্রতিবেদন না পাঠিয়ে একটি কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়। সেই সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। এ ক্ষেত্রেও পর্ষদের স্বাধীন সদস্য বুয়েটের উপাচার্যের আপত্তি উল্টে দেওয়া হয়। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রেও গণ খাতে ক্রয় আইন, বিধি ও দরপত্র দলিলের শর্ত লঙ্ঘন এবং জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে এসেছে।
প্রশাসনিক অভিযোগ শেষে দরপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে রিভিউ প্যানেলের দ্বারস্থ হয় যোগ্য বিবেচিত প্রতিষ্ঠানটি। রিভিউ নিষ্পত্তির আগেই পুনঃদরপত্র আহ্বান করে বিটিসিএল। নথিপত্র অনুযায়ী, পরবর্তী সময়ে আরও দুবার দরপত্র আহ্বান করে অনির্দিষ্টকালের জন্য দরপত্র স্থগিত করে বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ।
দুদক বলছে, রিভিউ প্যানেলের কাছে যেসব অনিয়মের লিখিত অভিযোগ দাখিল হয়েছিল, তাতে তিনজনের স্বাক্ষরিত সুপারিশসহ ছাপাকৃত প্রতিবেদনে তাঁদের অগোচরে পৃষ্ঠা নম্বর হাতে কেটে চারজনের ভিন্নমত যুক্ত করা, জালিয়াতি গোপন করতে আইন ও বিধি ভঙ্গ করে দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে না পাঠানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো রিভিউ প্যানেল লিখিত সিদ্ধান্তে না এনে অনিয়মগুলোর অস্তিত্বই বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। উল্টো যে অভিযোগ কেউ করেনি, তেমন এক কাল্পনিক আবেদনের অবতারণা করে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয় প্রস্তুতকারী কর্মকর্তাসহ প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেয় রিভিউ প্যানেল। যদিও প্রকল্প পরিচালক দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয় প্রস্তুত কমিটির সদস্যই ছিলেন না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিটিসিএলের জালিয়াতি ঢাকা দিতে রিভিউ প্যানেল এই কাল্পনিক শাস্তির ঘোষণা দেয়।
এভাবে বিটিসিএলের কর্মকর্তাদের জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে পুরো কাজটিই আটকে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, এই অনিয়মের বিষয়টি এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে তিনি প্রথম শুনেছেন। বিষয়টি কেউ তাঁকে জানাননি। তিনি বলেন, ‘কাউকে তো বিষয়টি আমাকে জানাতে হবে। তারপর না হয় আমি কিছু করতে পারব।’