শুধু নির্বাচন ঠিকভাবে করলে শেখ হাসিনাকে পালাতে হতো না: আনু মুহাম্মদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ঔদ্ধত্য এবং ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার একাগ্র বাসনা দেশের কী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তা আমরা দেখেছি। শুধু নির্বাচন ঠিকভাবে করলে শেখ হাসিনাকে পালাতে হতো না। তিনি এই দেশেই থাকতে পারতেন। কিন্তু নির্বাচনে হারতে পারেন, এই ঝুঁকি তাঁরা নিলেন না। ক্ষমতায় চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য তাঁরা সব প্রতিষ্ঠান শেষ করেছেন।’
আজ শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেন। ‘গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পর্যালোচনা ও জনতার অধিকার’ শীর্ষক এই সভার আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন চট্টগ্রাম।
সভায় লেখক আনু মুহাম্মদ ‘গণ-অভ্যুত্থান, বৈষম্য ও ভবিষ্যতে করণীয়’ বিষয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। এতে তিনি বলেন, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। ব্যাংক লুটপাট করে কিছু গোষ্ঠী বিত্ত ও ক্ষমতা বাড়িয়েছে। সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির (আমলাতন্ত্র) হাতে অসম্ভব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া যা চেয়েছে, তার চেয়ে বেশি দিয়েছে সরকার।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তির সমালোচনা করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ক্ষমতায় চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য বিগত সরকার বিভিন্ন অসম চুক্তি করেছিল। রামপালে সুন্দরবন বিনাশী প্রকল্প, আদানির সঙ্গে চুক্তি শেখ হাসিনা করেছিলেন। টিকে থাকার জন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছিল। তাদের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি পাঠ্যপুস্তক থেকে গুরুত্বপূর্ণ লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে।
স্বৈরশাসক তৈরি হওয়ার পেছনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কীভাবে ভূমিকা রাখে, এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন খুবই সুষ্ঠু হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক বিবৃতি দিয়েছিলেন। আদালত এখন অনেক মামলা খারিজ করে দিচ্ছেন। এই আদালতই বিগত সরকারের নির্দেশে অনেক অন্যায় সাজা দিয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ করে করে একটা গোষ্ঠী যা খুশি তা করতে পারে। এগুলোর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এসবের সঙ্গে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের ঘটনা ছিল। আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের ফল হলো গণ-অভ্যুত্থান।
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো হয়নি। এ জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর ৫৩ বছর পার হয়েছে। অথচ এখনো শহীদদের তালিকা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হয়নি। যে সরকার আসে, সে সরকারই নতুন নতুন তালিকা বানায়। এখন পর্যন্ত ঠিকমতো রাজাকারদের তালিকা হয়নি। এ অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এবারের গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতের তালিকা তৈরি করতে হবে। আহত ব্যক্তিদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।’
৫ আগস্টের পর বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় নিন্দা জানান আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন এক জায়গায় পৌঁছাতে হবে, যেখানে ধর্ম,লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণি ও পরিচয়ের কারণে কোনো মানুষ বৈষম্যের শিকার হবে না।’
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যে সমাজে দিনে–রাতে নারীরা নিরাপদে চলাফেরা করতে পারেন, সেটিই সভ্য সমাজ। এটি না পারলে সে সমাজকে কোনোভাবেই সভ্য বলা যাবে না। এ রকম সমাজ আছে। এটি কল্পনা নয়। আমরা বাংলাদেশকে এ জায়গায় দেখতে চাই।’
সভায় শিক্ষক ও অনুবাদক জি এইচ হাবীব বলেন, ‘৫৩ বছরের একটা দেশ ঠিক করতে হলে কত সময় লাগতে পারে, ভেবে দেখুন। দেশ পরিষ্কার করার কোনো লক্ষণ আমরা দেখছি না। এ সরকারের কিছু বিষয়ে অগ্রাধিকার থাকার কথা। কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখছি না। ফলে সবার মধ্যেই একটা হতাশা আছে।’
সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান খাজা ওসমান ফারুকী বলেন, ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে চিন্তাকে স্বচ্ছ করতে হবে। কিন্তু বহুমাত্রিক চিন্তা দ্বারা আমরা আক্রান্ত। কখনো পশ্চিমা, কখনো আরবীয়, কখনো নিজেদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চিন্তা দ্বারা আক্রান্ত হই।’
সভায় আরও বক্তব্য দেন গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের সদস্য হাফিজ আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মুনমুন নেসা চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের আহ্বায়ক অধ্যাপক তহুরীন সবুর। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক দীপা মজুমদার।