নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে হলো নববর্ষবরণ
রমনার বট-অশ্বত্থসহ অজস্র তরুলতা দুলছে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায়। আঁধার সরিয়ে উঁকি দিল বাংলা নতুন বছরের প্রথম সূর্য। বটমূলে লাল-সাদা বেশে ছায়ানটের শিল্পীরা যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে ছড়িয়ে দিলেন সুরের লহরি।
শুক্রবার, পয়লা বৈশাখ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। বাংলা বছরের প্রথম দিনটি শুরু হয় রমনার বটমূলে বর্ষবরণের ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতি সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে। সকালে সমবেত কণ্ঠে ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর’ গেয়ে ১৪৩০ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানান শিল্পীরা।
এরপর সারা দিন নানা আয়োজনে চলতে থাকে বর্ষবরণ উৎসব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই এই আয়োজনের মূল কেন্দ্র। সকাল নয়টায় শুরু হয় চারুকলা অনুষদের আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা।
কয়েক যুগ ধরেই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ মানুষ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আসছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আরও মানুষ যুক্ত হচ্ছে প্রাণের এই উৎসবে। শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকা প্রিয়জনকে অনেকেই বর্ষবরণের আয়োজনে ‘ভার্চ্যুয়ালি’ যুক্ত রাখেন মুঠোফোনের মাধ্যমে।
‘প্রতিবছর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন আমার মা। কিন্তু এবার আসতে পারেননি। শরীরটা সায় দেয়নি তাঁর। তাই সকাল থেকেই অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনে বসে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে পুরো অনুষ্ঠানটি মাকে লাইভ দেখিয়েছি,’ তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা রুহুল আমিন।
রমনার বটমূলে অনেককেই দেখা গেছে পুরো অনুষ্ঠানটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করতে। গণমাধ্যমকর্মীরাও তাঁদের ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচার করে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন বাংলার এ কৃষ্টি ও সংস্কৃতি।
পবিত্র রমজান মাস হওয়ায় এবারের পয়লা বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশের আয়োজন হয়নি। তবে পুরোনো গ্লানি, হতাশা আর মলিনতাকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নতুন বছর ১৪৩০-কে বরণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। যুদ্ধবিগ্রহের বিশ্বে শান্তির বার্তা কামনা করে শোভাযাত্রার এবারের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’।
সকাল নয়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড় হয়ে পুনরায় ক্যাম্পাসে গিয়ে শেষ হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার স্মৃতি ধরে রাখতে অনেকেই ছবি তুলে ও ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন।
তেমনই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা খন্দকার। লাল-সাদা শাড়ি পরা ফারজানার দুই গালে বৈশাখের আলপনা আঁকা। রোদের তাপে চেহারা কিছুটা মলিন হলেও অভিব্যক্তিতে ছিল উৎসবের আনন্দ। ফারজানা বলেন, ‘এই আনন্দ-উৎসবের প্রতিটি মুহূর্তকে ধরে রাখতে চাই। দেখাতে চাই, যারা এ প্রাণের উৎসবে আসার সুযোগ পায়নি তাদেরও। সেলফি ও ছবি তুলে এবং ভিডিও করে নিমেষেই আপলোড করে দিতে পারছি ফেসবুকে। এমন উৎসবে জনসমাগম খুব বেশি থাকে বলে অনেক সময়ই মোবাইলে নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়। কিন্তু এবার সে রকম কোনো সমস্যা হয়নি।’
বলতে বলতেই বন্ধুর সঙ্গে আরেকটা সেলফি তুলে পায়ে পা মিলিয়ে ফারজানা খন্দকার মিশে যান ভিড়ের মধ্যে। কারণটা জানা গেল, ফারজানা ব্যবহার করেন গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক।
এই নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থার উৎসটা কী? চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে টিএসসি পার হতেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দেখা গেল গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক টিমকে। একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হলেও মোবাইল নেটওয়ার্ক যেন নির্বিঘ্ন ও নিরবচ্ছিন্ন থাকে—সেটা নিশ্চিত করতেই ব্যস্ত এই টিমের সদস্যরা।
গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক টিমের পক্ষ থেকে জানানো হয়, উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনে আগত জনসমাবেশে গ্রামীণফোনের নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সেবা নিশ্চিত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন এলাকার মোট ৪২টি নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় সামঞ্জস্যের কাজ করা হয়েছে। এই স্থানে উপস্থিত থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছু দেখভাল করা হচ্ছে, যাতে তাদের গ্রাহকেরা বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের থেকে মুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন না হন।
কথার সত্যতা পাওয়া গেল একটু পরই এক দম্পতির সঙ্গে কথা বলে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে শোভাযাত্রায় অংশ নিতে স্বামী মিনহাজ ইসলামের সঙ্গে এসেছেন অনন্যা আক্তার। বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে এবারই প্রথম এমন উৎসবে আসা। তাই অনন্যার চোখে-মুখে ছিল আনন্দের ঝিলিক। গ্রামে বেড়ে ওঠা অনন্যা নতুন কেনা স্মার্টফোনে বাড়িতে থাকা ছোট বোনকে ছবি তুলে ও ভিডিও কলের মাধ্যমে বর্ষবরণের আয়োজন দেখাচ্ছেন। অনন্যা আক্তার বললেন, ‘এখানকার ছবি তুলে আর ভিডিও করে গ্রামে থাকা বোনকে পাঠাচ্ছি। মুহূর্তের মধ্যে ছোট বোন ও বাবা-মা, দাদিসহ সবাই একসঙ্গে বসেই আমার পাঠানো ছবি ও ভিডিও দেখতে পাচ্ছে।’
ইন্টারনেটের সুবাদে ঐতিহ্য ছড়াচ্ছে গ্রাম থেকে শহরে
সুচিত্রা দাস গৃহিণী, এসেছেন যশোর থেকে। তবে দূরত্বের কারণে পরিবার ও স্বজনদের সবাইকে আনতে পারেননি। তাই নিজের মুঠোফোনটি সচল ছিল সারাক্ষণ। কখনো ছবি তুলছিলেন, কখনো-বা ধারণ করছিলেন ভিডিও। আবার মাঝেমধ্যে বাড়িতে রেখে আসা স্বজনদের ভিডিও কলে দেখাচ্ছিলেন চড়কপূজা ও মেলার চিত্র। তবে সংগীতা সরকার ছিলেন বন্ধুদের নিয়ে। পূজা অর্চনা থেকে শুরু করে মেলা—সবাই মুঠোফোনে লাইভে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন বন্ধুদের।
এই দৃশ্যটি রাজধানীর নয়, পাবনার চাটমোহরের। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পাবনার চাটমোহর উপজেলার সদরের বোথর গ্রামে ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজা ও মেলা প্রাঙ্গণে মুঠোফোনের এমন ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। হাতে থাকা মুঠোফোন ও ইন্টারনেটের সুবাদে প্রায় ৬০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলাটি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল গ্রাম থেকে শহরে। দেশ থেকে বিদেশে।
মেলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে কথা হয় সংগীতা সরকারের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বাড়ি চাটমোহর উপজেলা সদরেই। বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। চড়ক মেলা ও পূজা উপলক্ষে বাড়িতে এসেছেন। আসার সময় বন্ধুদের বলে এসেছিলেন ফেসবুক লাইভে মেলা দেখাবেন, তাই ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন। ঢাকায় বসে বন্ধুরা পুরো মেলাটি দেখতে পেয়ে বেশ আনন্দিত।
সংগীতা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইন্টারনেটের সুবাদে দূরত্ব ঘুচে গেছে। গ্রামেও এখন নেটওয়ার্ক ভালো। তাই ইন্টারনেটের স্পিডও ভালো পাচ্ছি। ফলে বন্ধুদের সঙ্গে মেলার খুঁটিনাটি শেয়ার করতে কোনো সমস্যাই হয়নি।’
সরেজমিন পূজামণ্ডপ ও মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকঢোল আর বাদ্যের তালে মুখর পুরো প্রাঙ্গণ। পূজা-অর্চনায় ব্যস্ত পুরোহিতেরা। প্রচণ্ড দাবদাহ উপেক্ষা করেই তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। খঁগড়াই-জিলাপি থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী হাতপাখা, বাঁশের তৈরি কুলা-চালনি সবই স্থান পেয়েছে মেলায়। অনেকে এসব পণ্যের ছবি তুলছেন, কেউবা ভিডিও ধারণ করছেন। অনেকেই আবার ফেসবুক লাইভে দেখাচ্ছেন বন্ধুদের। তাঁদের সঙ্গে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক টিমের কর্মীদেরও দেখা পাওয়া গেল। যাঁরা ওই এলাকায় নির্বিঘ্ন নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে কাজ করছিলেন।
উপজেলা সদরের বাসিন্দা রনি রায় জানান, তাঁর অনেক আত্মীয়স্বজন ভারতে থাকেন। অনেকে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁরা চাইলেই পূজায় অংশ নিতে পারেন না। তাই ভিডিও কলেই তাঁদের পূজা উদ্যাপনের দৃশ্য দেখাচ্ছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক টিম প্রথম আলোকে জানায়, চৈত্রসংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রামীণফোন দেশব্যাপী নেটওয়ার্কের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। চাটমোহরের ঐতিহ্যবাহী চড়ক মেলা উপলক্ষে এই অঞ্চলের পাঁচটি টাওয়ারে সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সামঞ্জস্যের সমন্বয় করা হয়েছে। এতে গ্রাহকেরা ভালো নেটওয়ার্ক পাচ্ছেন।
চড়কপূজা ও মেলা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ দাস বলেন, ‘চড়কপূজাকে কেন্দ্র করে শত শত বছর ধরে মেলা উদ্যাপিত হচ্ছে। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী মেলাটি এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিদেশ থেকে এখানে বহু ভক্ত আসেন। অনেকে না আসতে পারলেও ইন্টারনেটের সুবাদে মেলা দেখতে পারেন। এ কারণেই এই মেলার নাম এখন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে গেছে।’