রাখাইনে সংঘাত: স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না সীমান্তের লোকজন
কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তে তিন দিন ধরে পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। তবে টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতভর থেমে থেমে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেছে। আজ শুক্রবার সকালে দুটি বিকট শব্দে এপারের মাটি কেঁপে ওঠে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সব মিলিয়ে সীমান্তের পরিস্থিতি এখন এই ভালো তো এই খারাপ। এমন সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে দুই জেলার তিন উপজেলার মানুষের মধ্যে। স্বজন হারানোর শোক কিংবা গুলির ক্ষত বয়ে বেড়ানো সীমান্তবর্তী মানুষ ফিরতে পারছেন না স্বাভাবিক জীবনে। তাঁদের ভেতরে কাজ করছে নতুন সংঘাতের আতঙ্ক। ওপারে সংঘাত বাড়লে এপারের সীমান্তবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা সবকিছুর ওপরই প্রভাব পড়ে।
২ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ তীব্রতর হয়। ইতিমধ্যে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এর আগে ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
৫ ফেব্রুয়ারি নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। এ ছাড়া গোলাগুলিতে আহত হন ৯ জন। নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও আহত লোকজন প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদকের কাছে নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরেছেন।
মাকে হারিয়ে ভালো নেই সন্তানেরা
৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া এলাকা থেকে ছোড়া মর্টার শেলে হোসনে আরাসহ দুজন নিহত হন। নিহত অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। এমন বিপর্যয় ঘটার আগে সুখ-সমৃদ্ধির অভাব ছিল না হোসনে আরার পরিবারে। হোসনে আরার স্বামী বাদশা মিয়া জলপাইতলী এলাকায় চায়ের দোকান আছে, বড় ছেলে শহীদুল্লাহ ইজিবাইকের চালক আর ছোট ছেলে ইব্রাহিম স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। কিন্তু একটি মৃত্যু থমকে দেয় সবকিছু। এ ঘটনায় হোসনে আরার নাতনি নুশরাত মনিও (৬) আহত হয়। এখন পরিবারের সবাই নুশরাতের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত। পাশাপাশি আবার নতুন করে সবকিছু শুরুর চেষ্টায় আছেন তাঁরা। তবে আবারও এমন কিছু ঘটবে না, সে নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তাঁরা।
হোসনে আরার বড় ছেলে ইব্রাহিম বলেন, মাকে হারিয়ে তাঁরা ভালো নেই। পরিবারের কেন্দ্রে ছিলেন মা। এখন মা নেই, তাই কিছু আগের মতো নেই। বাবা দোকান শুরু করতে পারেননি ভালোমতো। মাকে হারানোর শোকের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ার আতঙ্কও আছে।
নুশরাতের চিকিৎসায় এর মধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়েছে পরিবারের। তবে ১১ ফেব্রুয়ারি বিজিবি নুশরাতের চিকিৎসার খরচের জন্য এক লাখ টাকা অর্থসহায়তা দেয়।
আনোয়ারুলের চিকিৎসা চলছে ধার-কর্জে
৬ ফেব্রুয়ারি সকালে ধানখেতে কাজ করছিলেন উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর আনোয়ারুল ইসলাম (৪০)। সীমান্ত থেকে পালিয়ে আসা ১০-১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী আনোয়ারুলকে গুলি করার পাশাপাশি তাঁর দিকে হাতবোমা ছুড়ে মারেন। এ সময় তিনি ধানখেতে পড়ে যান। পরে তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গুলি ও হাতবোমার আঘাতে আনোয়ারুলের মুখমণ্ডলের একাংশ, কোমর ও এক পায়ের ঊরু ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। আনোয়ারুলের স্ত্রী মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘বিজিবি ৫০ হাজার টাকা অর্থসহায়তা দেয়। সে টাকা দিয়ে এত দিন চিকিৎসা চলেছে। এখন ধার-কর্জ করে স্বামীকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।’
মরিয়ম প্রথম আলোকে বলেন, ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর স্বামীর পেটে অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা হয়েছে। বোমা ও গুলিতে পেটের নিচের অংশ থেঁতলে ও ঝলসে গেছে। সুস্থ হতে কত দিন লাগে জানেন না তিনি। মরিয়মের আশঙ্কা, সুস্থ হলেও আনোয়ারুল আগের মতো দিনমজুরি করতে পারবেন না। দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে না পারলে খাবেন কী, বাচ্চাদের নিয়ে কার দরজায় দাঁড়াবেন, সেই শঙ্কা কাজ করছে তাঁর।
আনোয়ারুল ইসলামের তিন সন্তান রয়েছে। তাঁর বড় সন্তান আয়েশা বেগম (১২) রহমতের বিল দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণিতে, মেজ সন্তান মো. ইব্রাহীম (৭) রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ও ছোট সন্তান নুসরাত জাহান (৩ বছর ৬ মাস) শিশুশ্রেণিতে পড়ে। ছোট্ট আয়েশা সেদিনকার কথা ভুলতে পারেনি। সে বলে, ‘আমার বাবা কোনো অপরাধ করেনি। তারপরও বাবাকে গুলি করা হয়েছে, হাতবোমা মারা হয়েছে।’
এখনো আতঙ্কে আছেন প্রবীন্দ্র ধর
৪ ফেব্রুয়ারি সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজারসংলগ্ন হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা প্রবীন্দ্র ধর (৫০) বাড়ির উঠানে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর বাঁ বাহুতে গুলি এসে পড়ে। এখনো তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঘরের সবার চোখ ও মুখে এখনো আতঙ্কের চাপ। গত বুধবার পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটিতে এখনো দৈনন্দিন সাংসারিক জীবন শুরু হয়নি। প্রবীন্দ্র ধরের ছেলে লিটন ধর জানালেন, তাঁর বাবা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কেউ দেখতে যাননি। কোনো সহযোগিতাও পাননি তাঁরা। ওপারের গোলাগুলিতে তাঁরা মানসিক, শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুলির আঘাতে প্রবীন্দ্র ধরের ডান হাতের হাড় ভেঙে গেছে। তাঁর সেখানে অস্ত্রোপচার করতে হবে। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে প্রবীন্দ্র ধর প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলির ক্ষতের যন্ত্রণায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। বাড়ি ফিরতেও ভয় করছে।’