পাহাড়ের দুই জেলা
খালি পড়ে আছে ১০ কোটি টাকার পাঁচ ছাত্রাবাস
এক যুগ আগে খাগড়াছড়ির পানছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি ও মানিকছড়ি এবং রাঙামাটির কাউখালী ও লংগদুতে ছাত্রাবাসগুলো নির্মিত হয়।
ভবন হলেও খাবারের জন্য বরাদ্দ না হওয়ায় ছাত্রাবাস চালু হয়নি।
প্রতিটি ২ কোটি করে ৫টি ভবন নির্মাণে ব্যয় হয় ১০ কোটি টাকা।
একটি ছাত্রাবাসে ৯০ জন শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
ছাত্রাবাস চালু হলে অন্তত ৪৫০ জন শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা হতো।
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র মহেল ত্রিপুরার বাড়ি খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার দুর্গম ভারতবর্ষপাড়ায়। সে পড়ে পানছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার বাড়ি থেকে উপজেলা সদরের এই বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। পায়ে হাঁটা দুর্গম পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে এত দূর আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে মামার সঙ্গে বিদ্যালয়ের পাশে একটি ভাড়া কক্ষে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।
অথচ বিদ্যালয়ের পাশে রয়েছে একটি তিনতলা ছাত্রাবাস। দূরদূরান্তের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাসটি করা হয়েছিল ২০১০ সালে। নির্মাণের পর ছাত্রাবাস চালুই হয়নি। অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় ছাত্রাবাসটির দেয়ালে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। ঝুঁকি বিবেচনায় এটি এখন পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়।
মহেল ত্রিপুরা জানায়, তারা যে কক্ষে থাকে, সেটির ভাড়া তিন হাজার টাকা। খাওয়াসহ তাদের দুজনের খরচ হয় পাঁচ হাজার টাকা। ছাত্রাবাসটি চালু থাকলে মহেল ত্রিপুরার কোনো খরচই হতো না।
পানছড়ির এটিসহ খাগড়াছড়িতে তিনটি এবং রাঙামাটিতে দুটি ছাত্রাবাস নির্মাণের পর আর চালু হয়নি। খাগড়াছড়ির বাকি দুটির অবস্থান লক্ষ্মীছড়ি ও মানিকছড়িতে। আর রাঙামাটির দুটি ছাত্রাবাস কাউখালী ও লংগদু উপজেলায় নির্মাণ করা হয়েছে। দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য এই ছাত্রাবাসগুলো নির্মিত হয়। কিন্তু খাবারের জন্য বরাদ্দ না হওয়ায় ছাত্রাবাস চালু হয়নি।
এক যুগ আগে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি) আওতায় ছাত্রাবাসগুলো নির্মাণ করে। প্রতিটি ছাত্রাবাস নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় দুই কোটি টাকা। সেই হিসাবে পাঁচটি ভবন নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি টাকা। নির্মিত প্রতিটি ছাত্রাবাস তিনতলার। থাকার ব্যবস্থা রয়েছে ৯০ জন শিক্ষার্থীর। এর মধ্যে নিচতলা ও দোতলায় ৫০ জন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তৃতীয় তলায় থাকার ব্যবস্থা আছে ৪০ জন ছাত্রীর। নিচতলায় একটি মিলনায়তন এবং রান্নার জন্য আলাদা ঘর রয়েছে। আসবাব, বিদ্যুৎ সংযোগসহ সব ব্যবস্থা করা হয়।
জানতে চাইলে এলজিইডির খাগড়াছড়ি জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ভবন নির্মাণ করে শিক্ষা অফিসকে বুঝিয়ে দিয়েছি। কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটা তাদের বিষয়।’
এলজিইডি নির্মাণকাজ শেষে এই ভবনগুলো প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়কে বুঝিয়ে দেয়। জেলা পরিষদ থেকে জনবল এবং খাবারের খরচপ্রাপ্তি সাপেক্ষে শিক্ষার্থী তোলার কথা ছিল।
জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, ‘তিনটি উপজেলা—মহালছড়ি, গুইমারা ও দীঘিনালায় আগের তিনটি ছাত্রাবাস আমরা চালিয়ে নিচ্ছি। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু পরে করা ছাত্রাবাসগুলোর বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। ভবনগুলোও এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
সম্প্রতি পানছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের ছাত্রাবাসটিতে গিয়ে দেখা যায়, ভবনে তালা দেওয়া। পরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি মোহাম্মদ সিরাজ তালা খুলে ভবনটি ঘুরে দেখান। ভবনের নিচতলার কয়েকটি কক্ষে দেয়াল ও পিলারে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। মূল ভবন লাগোয়া রান্নাঘরটি ভেঙে অনেকটাই ধসে পড়েছে। দরজা-জানালা, আসবাব সব প্রায় নষ্ট।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, করোনার সময় এখানে কোয়ারেন্টিন করা হতো। চলতি বছরের ১০ আগস্ট ছাত্রাবাসটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। পানছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিপাশা সরকার বলেন, ছাত্রাবাস চালু থাকলে দূরের শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধা হতো। বিদ্যালয়ের পাশে এখন অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী ভাড়া বাসায় থেকে পড়ালেখা করছে।
লক্ষ্মীছড়ি সদর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেও রয়েছে একই ধরনের তিনতলা আরেকটি ছাত্রাবাস। এই ভবনও নির্মাণের পর ব্যবহৃত হয়নি। জানতে চাইলে লক্ষ্মীছড়ি প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শুভাশীষ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটির একাংশ পাশের ধুরং খালের ভাঙনে তলিয়ে গেছে। সোলার সিস্টেমও নষ্ট। উপজেলার বর্মাছড়িসহ ১২ কিলোমিটার দূরের দুর্গম এলাকার জন্য এই ছাত্রাবাস খুব দরকার ছিল।
মানিকছড়ি উপজেলা সদরে নির্মিত ছাত্রাবাসটিরও জানালা-দরজা ভেঙে গেছে। মানিকছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে এই ভবনের অবস্থান।
এদিকে রাঙামাটির কাউখালী ও লংগদু উপজেলায় দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত ছাত্রাবাস দুটির একটির অবস্থান কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের চেলাছড়া গ্রামে। অপরটি নির্মিত হয়েছে লংগদুর আটারকছড়া গ্রামে।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, দুটি আবাসিক ছাত্রাবাসের জন্য ২০১৩ সালের দিকে একজন নৈশপ্রহরী, দুজন বাবুর্চি, একজন ঝাড়ুদারসহ পাঁচজন করে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া পদাধিকারবলে আবাসিক ছাত্রাবাসের পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে হোস্টেল সুপার (তত্ত্বাবধায়ক) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু খাবারের জন্য বরাদ্দ হয়নি।
রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘ছাত্রাবাস দুটি চালু করা নিয়ে জেলা পরিষদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেবে। খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেলে দ্রুত আবাসিক ছাত্রাবাস দুটি চালু করা সম্ভব হবে।’ তবে রাঙামাটিতে বাকি চারটি ছাত্রাবাস ঠিকমতো চলছে বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, চেলাছড়া আবাসিক ছাত্রাবাসটির বেশ কিছু দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। পড়ে থাকা আসবাবগুলো অনেকটাই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ছাত্রাবাসের নৈশপ্রহরী লালন মণি চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ছাত্রাবাসের কর্মচারীরা বছরের পর বছর দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা না থাকায় অলস সময় পার করতে হচ্ছে।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্র জানায়, খাগড়াছড়ির পানছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি ও মানিকছড়ি এবং রাঙামাটির কাউখালী ও লংগদুতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩০৩টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৬ হাজার। এর মধ্যে ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৬০০ শিক্ষার্থী দুর্গম এলাকার বাসিন্দা। এসব ছাত্রাবাস চালু হলে অন্তত ৪৫০ জন শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা হতো।
এভাবে ভবন করে ফেলে রাখায় জনগণের অর্থ অপচয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেন খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মধু মঙ্গল চাকমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এত টাকা দিয়ে ভবন করে কারও লাভ হলো না। যাদের জন্য করা হয়েছে, তারা এই সুবিধা পেল না। এমন অপরিকল্পিত কাজ কাম্য নয়। এখন মেরামতের আওতায় এনে ভবনগুলো ব্যবহারের উপযোগী করা দরকার।