কক্সবাজারে ভারী বর্ষণ, পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে লাখখানেক মানুষ
লঘুচাপ সৃষ্টির প্রভাবে তিন দিন ধরে কক্সবাজারের সাগর উপকূল প্রচণ্ড রকম উত্তাল রয়েছে। সঙ্গে চলছে ভারী বর্ষণ। জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে আছেন অন্তত এক লাখ মানুষ। আজ রোববার ভোরে পেকুয়ার শিলখালীতে পাহাড়ধসে এক পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শনিবার রাত থেকে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে অর্ধশতাধিক ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল রাত ১১টা থেকে কক্সবাজারে ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে। কোথাও ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব চলছে। ঝোড়ো হাওয়ায় টেকনাফে হোয়াইক্যং ইউনিয়নে দুই শতাধিক গাছপালা ভেঙে গেছে। ২০টির বেশি বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকটি বৈদ্যুতিক খুঁটি উপড়ে পড়েছে। রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পাঁচ-সাতটি বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে ৩০টির বেশি গ্রাম অন্ধকার ডুবে আছে। ভারী বর্ষণে কক্সবাজার শহরের কলাতলী সৈকত সড়ক, প্রধান সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, টেকপাড়া, কালুদোকান এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান বলেন, আজ সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগের ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় আরও ১৯৪ মিলিমিটার। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে।
আজ ভোরে কক্সবাজার শহরের বৈদ্যঘোনা ও ঘোনাপাড়ার সাত-আটটি পাহাড়ে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি বসতবাড়ি হেলে পড়েছে। কাউন্সিলর রাজবিহারী দাশ বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে কতিপয় ব্যক্তি পাহাড় নিধনে নেমেছে। বৃষ্টির পানিতে পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে শহরের নালা-নর্দমা ভরাট হচ্ছে। কয়েকটি পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসতি করছে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ। মাইকিং করেও লোকজনকে সরিয়ে আনা যাচ্ছে না।
খাজা মঞ্জিল পাহাড়ের ঢালুতে বাঁশের বেড়ার ছোট্ট ঘরে বসতি করেন টমটমচালক রফিকুল ইসলাম। ভারী বর্ষণে তাঁর ঘরের তলার একাংশের মাটি সরে গেছে, ঘরটি কিছুটা হেলে পড়েছে। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঘরে অবস্থান করছেন তিনি। রফিকুল বলেন, পরিবার নিয়ে নিরাপদে বসবাসের বিকল্প ব্যবস্থা তাঁর নেই। তিন বছর আগে ৭০ হাজার টাকায় পাহাড়ের একখণ্ড জমির দখলস্বত্ব কিনে তিনি ঘরটি তৈরি করেন। এখন নিরাপদ স্থানে সরে গেলে ঘরটি অন্য কেউ দখল করে নিতে পারে। এই ভয়ে তিনি ঘর ছাড়ছেন না।
বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’–এর পরিসংখ্যান বলছে, শহরের প্রায় ৩ হাজার একর আয়তনের ছোট-বড় ৫১টি সরকারি পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে প্রায় ৬৬ হাজার ঘরবাড়ি। এসব ঘরবাড়িতে বসবাস করছেন ৩ লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে অন্তত ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে আছেন অন্তত ৩৫ হাজার মানুষ।
এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, গত ১২ বছরে পাহাড়ে শতাধিক ভূমিধসের ঘটনায় অন্তত ১০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ আজ ভোরে পেকুয়ার শিলখালীতে ভূমিধসের ঘটনায় স্থানীয় সরওয়ার কামালের স্ত্রী, মেয়ে ও নাতির মৃত্যু হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ভারী বর্ষণ শুরু হলে পাহাড়ধসের ঝুঁকি বাড়ে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনতে এলাকায় প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
ভূমিধস–আতঙ্কে রোহিঙ্গারাও, সরিয়ে আনা হয় ৪ হাজার
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, উখিয়ার বালুখালী, মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, জুমশিয়া, কুতুপালং, ময়নারঘোনা আশ্রয়শিবিরের অন্তত ২০-৩০টি স্থানে ৪০টির মতো ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে।
কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা সোনা মিয়া বলেন, কুতুপালং, মধুরছড়া, লম্বাশিয়াসহ বালুখালী-৮, ৯, ১০ ও ১১ নম্বর ক্যাম্পগুলো গড়ে তোলা হয়েছে উঁচু পাহাড় কেটে। ভারী বর্ষণ হলে পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে বড় বড় ফাটল ধরে। এখন বৃষ্টির পানিতে সেই ফাটল ধসে পড়ছে। ভূমিধসের শঙ্কায় আছেন অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ভূমিধসের অতিঝুঁকিতে থাকা অন্তত চার হাজার রোহিঙ্গাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছে। অন্যদের ভূমিধসের বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। প্রচারণাও চলছে।