১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই ‘কবি ভবন’ থেকে ১১৭ নম্বর কেবিনে ভর্তি করা হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। ১ বছর ১ মাস ৮ দিন থাকার পর এই কেবিনেই নিভে গিয়েছিল বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের এই অনন্য প্রতিভার জীবনপ্রদীপ। তবে হাসপাতালের কেবিনটি এখনো ঠিক আগের মতোই গুছিয়ে রাখা। বিছানা সাদা চাদরে ঢাকা। জানালায় সাদা পর্দা। বারান্দায় রয়েছে একগুচ্ছ সবুজ গাছপালা। দেখলেই মনে হবে বারান্দা থেকে এই বুঝি কবি কেবিনে ঢুকবেন। অথবা চেয়ারটি টেনে বসবেন।
আইপিজিএমআর বা বর্তমানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রশাসনিক ভবনের (ব্লক-বি) দোতলায় ১১৭ নম্বর কেবিনটিতে ঢুকতে তেমন বিধিনিষেধ নেই। দর্শনার্থী বা নজরুলপ্রেমীরা কিছুক্ষণ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। বিএসএমএমইউ এই কেবিনকে স্মৃতিকক্ষ হিসেবেই সংরক্ষণ করেছে।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ২৪ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে (১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট) তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
২৫ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে কেবিনের সামনে গিয়ে দরজা খোলাই পাওয়া গেল। হাসপাতালটিতে এমন একটি স্মৃতিকক্ষ আছে তা জানা না থাকলে খানিকটা থমকে দাঁড়াতে হবে। প্রেম ও বিদ্রোহের কবির ছবি হাসপাতালে কেন? কেবিনের দরজার বাইরে দুই পাশে কাঠের বোর্ডে নজরুলের তরুণ ও প্রবীণ বয়সের দুটো ছবি। এক পাশে স্মৃতিকক্ষের ছোট পরিচিতি। আরেক পাশে ২০২১ সালের ২৭ আগস্ট জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ এই কেবিন যাঁরা উদ্বোধন করেছিলেন, তাঁদের নাম লেখা।
কেবিনে ঢুকতেই দেয়ালে কবির নিজের হাতের লেখায় ‘চল্ চল্ চল্। চল্ চল্ চল্।। ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ কবিতার লাইনগুলো পড়ার সুযোগ মিলবে। এর পাশেই ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ ধূমকেতু পত্রিকায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার দেখা পাওয়া যাবে। নজরুলের বিখ্যাত বই সঞ্চিতা, মায়ামুকুর, বিষের বাঁশী, বুলবুল–এর প্রচ্ছদ, নজরুল স্মরণে বিভিন্ন পোস্টার, এগুলো কোলাজ করে দেয়ালে রাখা। ভেতরের বিভিন্ন দেয়ালে নজরুলের বড় বড় ছবি। শেলফে কবির লেখা এবং কবিকে নিয়ে অন্যদের লেখা বই।
দেয়ালে আরও আছে কলকাতার পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে ১৯২৮ সালে তোলা কবি ও প্রমীলা নজরুলের একটি বড় ছবি, মৃত্যুর সাত দিন আগে এ হাসপাতালে তোলা কবির ছবি, প্রমীলা ও নজরুলের কোলে তাঁদের দুই পুত্র সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধর ছোটবেলার ছবি। এ ছবির নিচে তথ্য দেওয়া রয়েছে—কবি তাঁর প্রিয় নেতা সান ইয়াৎ সেন ও লেনিনের অনুসরণে এই দুই ছেলের নাম রেখেছিলেন সানি ও নিনি। এ ছাড়া আছে কবির জীবনের বিভিন্ন সময়ের ছবি। ছোট পিতলের ফুলদানি, শিল্পী আনিসুজ্জামান ফারুকের বানানো কবির ছোট একটি ভাস্কর্য, গদি লাগানো দুটো এবং কাঠের একটি চেয়ারসহ টুকটাক আসবাব, ছোট একটি ড্রেসিং টেবিল দিয়ে ঘরটি সাজানো।
কেবিনে দর্শনার্থীরা স্মৃতিকক্ষ নিয়ে যাতে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন, সে জন্য একটি ছোট ব্রশিউর রাখা আছে শেলফে। সেখানে লেখা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘কবি ভবন’ থেকে কবিকে এই কেবিনে এনেছিলেন। কবির চিকিৎসায় যুক্ত ছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ডা. মেজর এ চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম, ডা. নাজিমুদ্দৌলা, ডা. আশিকুর রহমান খান প্রমুখ। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দেন চিকিৎসক বায়োজিদ খান। কবির সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকতেন নার্স শামসুন্নাহার ও ওয়াহিদুল্লাহ ভূঁইয়া।
১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কবি নজরুলকে সপরিবার বাংলাদেশে আনে। তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বসবাসের ব্যবস্থা করে ধানমন্ডিতে কবিকে একটি বাড়ি দেওয়া হয়। ৭৭ বছরের জীবনে কবির সৃষ্টিশীল জীবন ২৩ বছরের। মৃত্যুর পর কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালে কবিকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশে পদকে ভূষিত করা হয় কবিকে।
২৫ নভেম্বর তিন দর্শনার্থী ১১৭ নম্বর কেবিনে ঢুকলেন। যেন নিজের কোনো স্বজনকে দেখতে এসেছেন। তিনজনের একজন হলেন পিয়াসা পাত্র, আরেকজন ইসমত জাহান। তাঁরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে মাস্টার্সে পড়ছেন। পিয়াসা থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। আর ইসমত জাহান একটি মেসে থাকেন। ইসমত বললেন, কবির কেবিনের কথা জানতেন, কিন্তু কখনো আসা হয়নি। কাজের ফাঁকে ঢাকায় বেড়াতে আসা বড় বোন ও বন্ধুকে নিয়ে নজরুলের স্মৃতি ছুঁয়ে দেখতে এসেছেন।
কেবিনের পিতলের ফুলদানিতে তাজা ফুলের অনুপস্থিতি, অব্যবহার্য ড্রেসিং টেবিল আর শূন্য বিছানা বলে দেয়, কবি নেই, এখানে ধরা আছে তাঁর স্মৃতি।