জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন: অনলাইনে নিজে আবেদন বন্ধ
যে কেউ অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের আবেদন করতে পারতেন। পরে ই–পেমেন্টের মাধ্যমে নির্ধারিত ফি পরিশোধের পর আবেদন ফরম নিয়ে জমা দিতেন সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক কার্যালয়ে। তবে দুই দিন ধরে কেউ নিজে অনলাইনে আবেদন করতে পারছেন না। আবেদনের জন্য bdris.gov.bd ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে অনুমোদিত ‘ইউজার নেম’ ও ‘পাসওয়ার্ড’ চাওয়া হচ্ছে, যা শুধু নিবন্ধকদের কাছে থাকে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় জানিয়েছে, সাময়িকভাবে ব্যক্তির নিজে অনলাইনে আবেদন করার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় নতুন আবেদন ও সংশোধনের জন্য সার্ভারে কাজ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনলাইনে ব্যক্তির নিজে আবেদন করা বন্ধ থাকার বিষয়ে আজ মঙ্গলবার রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় একটি নোটিশ জারি করেছে ওয়েবসাইটে। নোটিশে লেখা, ‘নিবন্ধনের সার্ভার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সর্বসাধারণের প্রবেশ বন্ধ আছে।
সার্ভার সুরক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত অনলাইনে ব্যক্তির নিজে আবেদন করা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। সমস্যাটা সাময়িক।
কেবলমাত্র সকল অথরাইজড ইউজার প্রবেশ করতে পারবে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সকল সেবার ক্ষেত্রে সকল সেবাপ্রার্থীকে ও আবেদনকারীকে তাঁর নিকটস্থ নিবন্ধক কার্যালয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে নিবন্ধনের আবেদন দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হলো। সাময়িক এ অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
আবেদন বন্ধের কারণ
জানা গেছে, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সেবা নেওয়া লাখ লাখ মানুষের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে অনলাইনে নিজে আবেদন করার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সার্ভার সুরক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত এই সুযোগ চালু করা হবে না।
কারিগরি ত্রুটি ও দক্ষ লোকের অভাবে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় থেকে তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কারিগরি ত্রুটির কারণেই তথ্য উন্মুক্ত অবস্থায় ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম টেকক্রাঞ্চ গত ৭ জুলাই এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে একটি সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের তথ্য ফাঁস হয়েছে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তারা ওই সময় ওয়েবসাইটটির নাম প্রকাশ করেনি। পরে তারা আরেকটি প্রতিবেদনে জানায়, সংস্থাটি জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়।
১০ জুলাই তথ্য ফাঁসের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থার মহাপরিচালককে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কারিগরি ত্রুটি ও দক্ষ লোকের অভাবে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয় থেকে তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কারিগরি ত্রুটির কারণেই তথ্য উন্মুক্ত অবস্থায় ছিল। সংস্থাটি সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে কাজ করলেও তাদের দক্ষ লোকবল ছিল না। একজন প্রোগ্রামার ও প্রয়োজনে আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে লোক এনে কাজ করানো হতো। এ ছাড়া যে প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সফটওয়্যার বানানো হয়েছিল, তাদের কাছ থেকে সবকিছু ভালোভাবে বুঝেও নেওয়া হয়নি।
আবেদন করতে গিয়ে সমস্যা ধরা পড়ে
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রফিকুল ইসলাম গতকাল সোমবার নিজের ল্যাপটপে ছোট বোনের নামের সংশোধনের জন্য আবেদন করতে যান। সফটওয়্যারে প্রবেশ করে দেখেন ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড চাওয়া হচ্ছে। তিনি আর আবেদন করতে পারেননি। কী ঘটনা ঘটেছে বা এর সমাধানই–বা কী বুঝতে পারছিলেন না তিনি।
আজ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল–৫–এ গিয়ে দেখা যায়, নিজে অনলাইনে আবেদন করতে না পেরে নিবন্ধক কার্যালয়ে খবর নিতে এসেছেন কেউ কেউ। নিজে আবেদন করা যাবে না জানার পর কার্যালয়ে কর্মীদের মাধ্যমে আবেদন করেছেন তিনজন। তেমন একজন মোসাম্মত সানজানা আক্তার সাথী (১৫)।
মোহাম্মদপুর থেকে চাঁন মিয়া নামের একজন এসেছিলেন পরিচিতজনের মৃত্যুনিবন্ধন সংশোধন করতে। চাঁন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দোকান থেকে নাম সংশোধনের জন্য আবেদন করতে গিয়ে দেখেন আবেদন করা যাচ্ছে না। পরে নিবন্ধক কার্যালয়ে চলে আসেন।
তেজগাঁও থেকে আশিক মোহাম্মদ সাগর নামের এক ব্যক্তিও আসেন নাম সংশোধনের বিষয়ে খোঁজ নিতে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দোকান থেকে আবেদন করা যাচ্ছে না। তাই তিনি খোঁজ করতে এসেছেন।
আজ ওই কার্যালয়ে তিনজন নতুন আবেদন, তিনজন সংশোধন, দুজন সনদ নেওয়ার জন্য এসেছিলেন। নতুন আবেদনের মধ্যে একজনেরটা অনলাইনে ডুপ্লিকেট (দ্বৈততা), অর্থাৎ একই নামে নিবন্ধন পাওয়া যাওয়ায় ফেরত দিয়েছে নিবন্ধক কার্যালয় এবং ওই ব্যক্তিকে নতুন আবেদন না করে সংশোধন করতে বলেছে।
অঞ্চল–৫–এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম ওয়াসিমুল ইসলাম এই নিবন্ধক কার্যালয়ের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আবেদনের জন্য ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ডের অনুমোদিত ব্যক্তি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, লোকজন খোঁজ করার পর তাঁরা জানতে পেরেছেন, অনলাইনে কেউ আবেদন করতে পারছেন না। তিনি বলেন, দুই দিন ধরে অল্পসংখ্যক আবেদন আসছে বলে তাঁরা করে দিতে পারছেন। আবেদনের জন্য বেশিসংখ্যক লোক কার্যালয়ে এলে তাঁদের ওপর চাপ পড়বে। আরও দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হবে।
ওই কার্যালয়ে ১৫ দিন ধরে সার্ভারে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। আজ সকালের দিকেও সমস্যা ছিল।
এদিকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সার্ভারে কাজ করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ১৫ জুলাই জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার কড়াইচড়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দুই বছরের মেয়ের জন্মনিবন্ধন করেন মো. ইসমাইল হোসেন সাদী। তবে তাঁর নামের ইংরেজি বানান ভুল হওয়ায় তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তা সংশোধনের আবেদন করেন। পরে আবেদন ফরমটি নিয়ে কার্যালয়ে যান। কিন্তু সার্ভারে নিবন্ধক কিছুতেই প্রবেশ করতে পারছিলেন না। আজ সার্ভারে প্রবেশ করা গেলেও আপলোড, ডাউনলোড কিছু করা যাচ্ছে না।
‘সমস্যা সাময়িক’
অনলাইনে আবেদন বন্ধ থাকার বিষয়ে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান আজ প্রথম আলোকে বলেন, সার্ভার সুরক্ষিত করার কাজ করা হচ্ছে। সার্ভার সুরক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত অনলাইনে ব্যক্তির নিজে আবেদন করা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। সমস্যাটা সাময়িক।
কবে নাগাদ তা চালু হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। নিবন্ধক কার্যালয় এতসংখ্যক আবেদন নিজেরা পূরণ করতে গিয়ে চাপে পড়বে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছুটা চাপ তৈরি হবে। আপাতত কিছু করার নেই।
সার্ভার সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সার্ভার কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, যেসব জায়গায় সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে, সেসব জায়গায় তা ঠিক করা হচ্ছে।