মিয়ানমার ইস্যুতে কোন পথে এগোবে বাংলাদেশ

অস্ত্র ও কূটনীতির যুদ্ধ মিলে মিয়ানমার পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তবে বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের মিয়ানমার নীতি খুব বেশি পাল্টায়নি।

মিয়ানমারে গণতন্ত্রীপন্থীদের বিক্ষোভ ঠেকাতে মাঠে সেনাবাহিনীর সশস্ত্র অবস্থান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমারের ঘটনাবলিকে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম ‘গৃহযুদ্ধ’ বলে। কিন্তু মিয়ানমারের প্রধান জাতিসত্তা বামারদের ‘যুদ্ধ’ মোটেই আর নিজ গৃহে আটকে নেই। পরস্পর ভাগ হয়ে বহু দেশে তারা শক্তি পরীক্ষায় নামছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত অনেক দেশে মিয়ানমারের কূটনীতিবিদেরা দুই জায়গায় অফিস করে এখন। একদল কাজ করে সামরিক জান্তার জন্য; অন্য দল সু চির ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ বা এনইউজির পক্ষে।

অস্ত্র ও কূটনীতির যুদ্ধ মিলে দেশটির পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। মোটাদাগে এই বাঁকবদলের ছাপ পড়েছে জাতিসংঘ থেকে আসিয়ান পর্যন্ত সব আন্তর্জাতিক ফোরামে। তবে বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের মিয়ানমার নীতি খুব বেশি পাল্টায়নি। সম্প্রতি কয়েকটি বিদেশি গণমাধ্যম থেকে জানা গেল, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ঢাকা আবারও বেইজিংয়ের কাছে অনুরোধ করেছে। ‘বন্ধু’র কাছে প্রায় পাঁচ বছরের পুরোনো অনুরোধ এটা। তবে যেকোনো বন্ধুত্ব ধৈর্য চায়। বাংলাদেশের ধৈর্যের প্রশংসা করতেই হবে।

ছোট হয়ে আসছে জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের জগৎ

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জন্য সর্বশেষ বড় আঘাত এসেছে আসিয়ান বৈঠক থেকে। বিশ্বের কেবল এই ফোরামে এত দিন জেনারেল মিন অং হ্লাই সাবলীলভাবে যেতে পারতেন। কিন্তু সর্বশেষ কম্বোডিয়া বৈঠকে আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জানালেন, শান্তির পথে বিশ্বাসযোগ্য অগ্রগতি ছাড়া তাঁরা আর জেনারেল মিনকে জোটের বৈঠকে দেখতে চান না।

কম্বোডিয়া থেকে এ রকম সিদ্ধান্ত আসা মিন অং হ্লাইয়ের জন্য বাড়তি দুঃখের বিষয়। ওখানকার একনায়ক হুন সেন তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলে ধারণা করা হতো। আবার চীনেরও ‘বন্ধু’ হুন সেন। কিন্তু কেবল ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল নন—কম্বোডিয়া বৈঠকে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থী ছাত্র-তরুণদের ফাঁসি দেওয়া শুরু হওয়া মাত্র দেশটির সামরিক জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একনায়কদের জন্য ক্রমে নৈতিকভাবে বিব্রতকর হয়ে উঠছে।

আসিয়ানের মিয়ানমার নীতি পাল্টাতে এ মুহূর্তে বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকায় আছেন মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন আবদুল্লাহ। তাঁর অভিমত, আসিয়ানের উচিত মিয়ানমার বিষয়ে এনইউজির সঙ্গে কথা বলা।

মিয়ানমারে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া বেইজিং

আসিয়ান জোটের ভেতর মিয়ানমার নীতির এ রকম নাটকীয় পরিবর্তন চীনের জন্য উদ্বেগজনক এবং তিরস্কারমূলক। ১০ সদস্যের এ জোট সচরাচর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা যুদ্ধে বাফারজোনের মতো কাজ করে। জেনারেল মিনকে সেখানে নিষিদ্ধ করার মানে আসিয়ান অঞ্চলে ওয়াশিংটনের স্পষ্ট এক কূটনৈতিক অর্জন। মাত্র গত জুলাইয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মিয়ানমার সফর করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই জেনারেলদের প্রধান কূটনীতিক ভরসা এখন চীন।

আসিয়ান জোটেও চীনের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার চাপে চীন সেখানে জেনারেল মিনকে আর গ্রহণযোগ্য রাখতে পারছে না। এভাবে উত্তর কোরিয়ার মতো এই ‘একনায়ক-বন্ধু’ও ক্রমে আন্তর্জাতিক সমাজে চীনের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে চীনের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের বড় এক যোগসূত্র মিয়ানমার।

কুনমিং থেকে আরাকানের কাইয়াকপু পর্যন্ত রেললাইন বসাতে চাইছে তারা। এত দিন এ পথে কেবল চীনা পাইপলাইনের কথাই শুনেছে বিশ্ব। কিন্তু নতুন করে তাতে যুক্ত হয়েছে রেলপথের পরিকল্পনা, যে পথ ভারত মহাসাগরের সঙ্গে চীনের সরাসরি যোগাযোগ ঘটাবে। চীন থেকে কেন্দ্রীয় মিয়ানমারের মান্দালে পর্যন্ত আরেকটি রেললাইন তৈরিরও কথা চলছে।

এসব উদ্যোগের সময়ে পশ্চিমের বন্ধু গণতন্ত্রপন্থীদের হাতে মিয়ানমারের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবছে বেইজিং। হয়তো সে কারণেই ২০১৫ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে পাঁচবার চীন সফর করেও অং সান সু চি দেশটির মন রক্ষা করতে পারেননি। যে মন গভীর বন্ধনে আটকে আছে বামার জেনারেলদের সঙ্গে।

রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল কমছে

চীন-মিয়ানমার সম্পর্কের ঐতিহাসিক রসায়ন ঢাকার নীতিনির্ধারকদের জানা। সেই হিসাব থেকেই হয়তো তাঁরা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে আবারও বেইজিংয়ের সহযোগিতা চেয়ে থাকবেন। ৭ আগস্ট চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর ঢাকায় সফরকালে বাংলাদেশের পুরানো ওই প্রত্যাশার কথা আবারও জেনে থাকবেন।

কিন্তু এটা এমন এক প্রত্যাশা ও আশ্বাস যা কোনো ফল দিচ্ছে না। বরং কক্সবাজার থেকে ভাসানচর পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেশে ফেরার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসে মোটাদাগে চিড় ধরেছে। তাদের মনোবল ফেরানোর মতো কোনো রোডম্যাপ ঢাকার হাতে আছে কি না, সে বিষয়েও গভীর সন্দেহ আছে দেশে-বিদেশে।

ফেরত পাঠানো নিয়ে যত অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে, ততই সামনে আসছে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রশ্ন। শিক্ষা ও কাজের জন্য প্রশিক্ষিত না করে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষকে এভাবে কত দিন আশ্রয়শিবিরে রেখে ভরণপোষণ দেওয়া যাবে—সে প্রশ্ন অনেককে ভাবাচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ ইতিমধ্যে ইউরোপের অনেক দেশকে এশিয়ামুখী মানবাধিকার সহায়তা কমাতে বাধ্য করছে। আগে-পরে এর ছাপ পড়বে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। কিছু ছাপ পড়েও গেছে।

কক্সবাজারের প্রায় প্রতিটি আশ্রয়শিবিরে ‘অপ্রয়োজনীয়’ চিহ্নিত করে এত দিনকার অনেক কর্মসূচির বাজেট কমাচ্ছে দাতারা। আগামী বছর এ রকম অনেক কর্মসূচি বন্ধও হতে পারে বলে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ প্রবণতা যত বাড়বে, ততই রোহিঙ্গাদের দেখাশোনার খরচপাতি বাংলাদেশের কাঁধে আসতে থাকবে।

ইউক্রেন ইউরোপ-আমেরিকার মানবাধিকার সহায়তায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসছে, যা এখনই বাংলাদেশের সতর্ক মনোযোগ দাবি করে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজে যুক্ত এনজিও সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বর্তমানে শিবিরগুলোতে যে পরিমাণ অর্থ দরকার, তার চার ভাগের এক ভাগ কেবল পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এটাও কমবে।

দক্ষিণ সীমান্তে বাংলাদেশের জন্য নতুন আরেক উদ্বেগ তৈরি করছে রাশিয়া। মিয়ানমারের জান্তাকে ক্রমাগত সামরিকভাবে সুসজ্জিত করছে তারা। গৃহযুদ্ধকবলিত এবং উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্তের অপর পাড়ে এ রকম রণসজ্জা বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ বিদেশনীতির জন্য গভীর দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যদিও রাশিয়াকে বাংলাদেশের ‘বন্ধু’রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হয়।

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশকেও বিপদে ফেলেছে

সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের ‘সিনিয়র জেনারেল’কে বিশ্বের কম দেশই স্বাগত জানিয়েছে। এ তালিকায় সর্বাগ্রে আছে পুতিনের রাশিয়া। গত দুই বছরে একাধিকবার জেনারেল মিন মস্কো গেছেন। তিনি ও তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘যুদ্ধাপরাধ’-এর অভিযোগ ওঠা এবং তদন্ত চলাকালেই রাশিয়া মিয়ানমারকে যুদ্ধবিমানসহ নানান ধরনের সামরিক সহায়তা দিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে।

মিয়ানমারের জ্বালানি খাতেও রাশিয়ার ভূমিকা বাড়তে পারে নতুন করে। টোটাল, শেভরন, শেল ইত্যাদি কোম্পানি মিয়ানমার ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষণার পর জ্বালানি খাতে রাশিয়ার সংস্থাগুলোকে টানতে চাইছেন নেপিডোর শাসকেরা। এ খাত রাজস্ব আয়েরও গুরুত্বপূর্ণ এক স্তম্ভ। টোটাল আর শেভরন মিলে সরকারকে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার রাজস্ব দিত উপকূলীয় ইয়াদানা থেকে গ্যাস উত্তোলনের বিনিময়ে। এখন তার বিকল্প দরকার।

এ ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য নতুন করে অস্ত্রপাতি লাগছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সশস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধাদের নির্মূল করতে ‘তাতমাদা’ নামে পরিচিত মিয়ানমার সেনাবাহিনী বর্তমানে স্থলবাহিনীর বদলে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে বেশি। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এ রকম অভিযানগুলোতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে রুশ মিগ-২৯, ইয়াক-১৩০ এবং চীনের এফ-৭ বিমান।

তবে চীন ও রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতার পরও মিয়ানমারজুড়ে গৃহযুদ্ধে সশস্ত্র গণতন্ত্রপন্থীদের কোণঠাসা করতে পারছে না তাতমাদা। জান্তার পোড়ামাটি নীতি এনইউজির ‘ডিফেন্স ফোর্স’কে ‘মৃত্যু বা বিজয়’ অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। পাশের দেশের রাজনীতিতে এভাবে আপসের সুযোগ কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোন পক্ষের সঙ্গে আলোচনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া ঠিক হবে—সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না ঢাকা।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এনইউজি নেতাদের সম্প্রতি কিছু যোগাযোগ হয়েছে বলে দাবি করছে শেষোক্ত পক্ষ। তবে সেসব যোগাযোগ মিয়ানমার প্রশ্নে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তহীনতা কাটাতে পারেনি।

আগামী বছর সংঘাত বাড়তে পারে

তবে বাংলাদেশের জন্য একটা আশার দিক, রোহিঙ্গা প্রশ্নে এনইউজি গত এক বছরে অনেক অগ্রসর অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতায় এলে নাগরিকত্ব আইন সংস্কার এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে দেশে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে তাদের অবস্থান এখন ইতিবাচক। বাংলাদেশের সঙ্গে এখনি যোগাযোগের ব্যাপারে আগ্রহী তারা।

তবে জান্তার প্রতি চীন-রাশিয়ার মদদ মোকাবিলায় এনইউজির কূটনীতিক অগ্রাধিকার এখন ইউরোপ-আমেরিকা। রোহিঙ্গা বিষয়ে তাদের নমনীয় অবস্থানের এটাও একটা কারণ। পশ্চিমের সহায়তা নিয়ে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স নামে পরিচিত নিজেদের সশস্ত্র শাখা পিডিএফের যুদ্ধক্ষমতা বাড়াতে চায় তারা। এ যুদ্ধে ইতিমধ্যে দেশজুড়ে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ মারা যাওয়ার খবর এসেছে।

সম্প্রতি দেশটির বিভিন্ন শহরে চীনের তৈরি নজরদারি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে ব্যাপকভাবে। গেরিলাদের গতিবিধি নজরে রাখা এবং তরুণদের বিক্ষোভ মিছিল নিয়ন্ত্রণে এসব ক্যামেরার মুখ শনাক্ত প্রযুক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে। তারপরও রেঙ্গুন ও নেপিডোতে সবার শঙ্কা, ২০২৩-এ দেশজুড়ে সংঘাত ব্যাপকভাবে বাড়বে।

এটা কেবল পিডিএফ গেরিলাদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই ঘটবে না, সংঘাত বাড়ার আরেকটি উপলক্ষ হবে জান্তার নিজের মতো করে নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা। জেনারেলরা আগামী বছর নির্বাচন করে বেসরকারি একটা পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন বলে দেশজুড়ে জল্পনা–কল্পনা চলছে।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যুদ্ধাপরাধের রায়ের সম্ভাবনাও ধীরে ধীরে ধেয়ে আসছে জেনারেল মিনসহ তাঁর প্রায় ২০ সহযোগীর বিরুদ্ধে। সে জন্য নিজেদের ভাবমূর্তিতে বেসামরিক প্রলেপ দিতে নির্বাচনকে বড় করণীয় ভাবছে তাতমাদা।

নাফ উপকূলে ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তাপ

মিয়ানমারে ২০২৩-এর সম্ভাব্য নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য নতুন দুর্ভাবনা ও করণীয় হাজির করতে পারে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকানে এই নির্বাচন রাজনৈতিক জটিলতা বাড়াবে। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) নিশ্চিতভাবে এই নির্বাচন বর্জন করবে। অন্যদিকে আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান বা ইউএলএসহ অন্যান্য আঞ্চলিক দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের প্রদেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব দখল করে নিতে পারে।

অতীত তিক্ত সম্পর্কের কারণে আরাকানে ইউএলএ এনএলডিকে দুর্বল করার যেকোনো সুযোগ গ্রহণ করবে বলেই ধারণা করা যায়। তবে ইউএলএ নির্বাচন না করলেও রোহিঙ্গাদের কখনো নিজ ভিটায় ফেরত পাঠাতে হলে বাংলাদেশকে এই দল—তথা আরাকান আর্মির সঙ্গে দর–কষাকষিতে আসতেই হবে। যদিও সে রকম দর–কষাকষির জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগের রাজনৈতিক গোড়াপত্তন হয়নি আজও।

আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার স্বীকার করলেও তাদের সঙ্গে প্রশাসনিক নেতৃত্ব ভাগাভাগি করতে এখনো প্রস্তুত নয়। আরাকান আর্মিসহ আকিয়াবকেন্দ্রিক রাখাইন-প্রধান দলগুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব থাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা আছে।

অথচ আরাকানে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ অবস্থানের জন্য প্রদেশের উত্তরে নিজ এলাকায় স্বায়ত্তশাসন ও প্রদেশের কেন্দ্রে প্রশাসনিক নেতৃত্বে হিস্যা পাওয়া জরুরি। কিন্তু নিজেদের শক্তিশালী কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব না থাকায় এ রকম দাবিগুলো রোহিঙ্গারা দেশে-বিদেশে জনপ্রিয় করতে পারেনি আজও।

বাংলাদেশও তার এত দিনকার চীনমুখী কূটনীতির কারণে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক সত্তা হয়ে ওঠায় নিরুৎসাহ বজায় রেখে চলেছে। এর অন্তত দুটি খারাপ পার্শ্বফল দেখা যাচ্ছে ইতিমধ্যে। একদিকে কক্সবাজারে আশ্রয়শিবিরগুলোতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে অনেক রোহিঙ্গা সংগঠক মারা যাচ্ছে, যা রোহিঙ্গাদের জন্য অপূরণীয় এক ক্ষতি।

দ্বিতীয়ত, প্রতিনিধি হিসেবে জনস্বীকৃতি না থাকায় কোনো রোহিঙ্গা সংগঠকের পক্ষে আরাকান আর্মির রাখাইন সংগঠকদের সঙ্গে কার্যকর কোনো বোঝাপড়ায় আসাও সম্ভব হচ্ছে না। প্রদেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং বৌদ্ধ রাখাইন ও মুসলমান রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য যে বোঝাপড়া অপরিহার্য।

দক্ষিণ সীমান্তে যখন এত সব চ্যালেঞ্জ, ঠিক তখন বৈশ্বিক ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তপ্ত আলামত যেন ধেয়ে আসছে নাফ উপকূলে।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক