চা–শ্রমিকের খাবার ‘পাতিচখা’
একবার এক সম্রাটের উষ্ণ পানির পাত্রে কিছু অচেনা পাতা পাশের গাছ থেকে উড়ে এসে পড়েছিল। বুনো গাছের সেই পাতার রং মিশে যাওয়া পানীয় সাহস নিয়ে পান করলেন তিনি। অনুভব করলেন, তাঁর মধ্যে সতেজতা কাজ করছে। আবিষ্কৃত হলো চা–পাতার। যুক্তরাজ্যের ফুড অ্যান্ড ড্রিংক ফেডারেশনের ওয়েবসাইট ‘ইউকে টি অ্যান্ড ইনফিউশন’–এ পাওয়া যায় এই কিংবদন্তি গল্পটি। ২ হাজার ৭৩৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনা সম্রাট শেন নাং-এর চা–পাতা আবিষ্কারের ইতিহাস এটি।
সেই চা–পাতা যে একটি জনগোষ্ঠীর শ্রমিকের দুপুরের খাবার হবে, তা অবশ্য চা–বাগান তৈরি হওয়ার আগে জানা যায়নি। ‘পাতিচখা’ নামের খাবারটি তৈরি হয়েছে অভাব আর শ্রমের কষ্ট সমন্বয় করে। বাগানে কাজ করার সময় চা-বাগানের কমবেশি সব শ্রমিকের দুপুরের খাবার এটি। এর প্রচলন নিয়ে আছে একাধিক মতামত। ১৬ নভেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা–বাগানের ১০ নম্বর সেকশনে চা–শ্রমিকদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে বসে পাওয়া গেল এর কিছু অংশ।
নারী চা–শ্রমিকেরা বললেন, বংশপরম্পরায় তাঁরা যেমন শ্রমিক, তেমনি এই খাবারও বহু প্রজন্মের অভ্যাস। তাঁরা চা–পাতা তুলতে বাড়ি থেকে আসেন ভোরবেলায়। যে চালের ভাত রান্না করেন, সেটি দীর্ঘ সময় ভালো থাকে না, গন্ধ হয়ে যায়। ফলে রুটি আনাই নিরাপদ। আর ভাতের সঙ্গে অন্তত একটি তরকারির প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ চা–শ্রমিক বললেন খরচের কথা। দিনে ১৭০ টাকা আয় করা মানুষ নিজের খাওয়ার জন্য এতটা খরচ করতে পারেন না।
কেউ কেউ বললেন, ভাত খেলে শরীর ভার হয়ে আসে, তখন ঘুরে ঘুরে পাতা তুলতে কষ্ট হয়। তাঁরা পাতিচখা খান ঘুম তাড়াতে। ‘উনা ভাতে দুনা বল/ অতি ভাতে রসাতল’ গ্রাম্য প্রবাদটি যেন তৈরি হয়েছে এই চা–শ্রমিকদের মানসিক ভরসা দিতে। রুটি বা ভাত যা–ই খান, পাতিচখা থাকে সঙ্গে। পাতিচখা বানানো হয় চা–পাতা হাতের তালুতে ডলে। প্রয়োজন হয় সেই একটি কুঁড়ি আর দুটি পাতা। সঙ্গে থাকে পোড়া আলু, পেঁয়াজ, চানাচুর আর অনেক মরিচ। সবশেষে মুড়ি দিয়ে সবকিছু মিশিয়ে মাখানো হয়।
পাতিচখার অবিচ্ছেদ্য অংশ লবণ মিশিয়ে জ্বাল দেওয়া চা–পাতার পানি। নারী শ্রমিকেরা জানান, এই পানীয় তাঁরা বাগানে ঢোকার সময় বোতলে করে নিয়ে আসেন।
চা–বাগানে কাজের জন্য এই ঝাল আর নোনা স্বাদের প্রয়োজন হয় বলে জানালেন নারী শ্রমিকেরা। ওই ঝাল যে শরীরের ক্লান্তি হরণ করে, তা টের পাওয়া গেল বিশুমতি হাজরার তুলে দেওয়া এক দলা পাতিচখা মুখে দিয়ে।
আগের দিন (১৫ নভেম্বর) দুপুরে শ্রীমঙ্গলের দার্জিলিং টিলায় দেখা হয়েছিল ফুলছড়া চা–বাগানের সরস্বতী বুনার্জির সঙ্গে। তিনি জানিয়েছিলেন, পাতিচখা খেতে হলে দুপুর ১২টার আগে বাগানে ঢুকতে হবে। আর ঝালের ব্যাপারে তাঁর মতামত—ওটুকু না হলে খাওয়া যায় না।
সরস্বতী বুনার্জির পরামর্শ শুনে পরদিন দুপুরে ভাড়াউড়া চা–বাগানে গিয়ে বোঝা গেল, শ্রমিকদের মেপে আনা ওই সামান্য আহারটুকুতে পাত পাড়তে চাওয়া অন্যায়। তবুও মায়া হাজরা আর কিশোরী চা–শ্রমিক পায়েল হাজরা তুলে দিয়েছিলেন নিজেদের জন্য তৈরি করা পাতিচখার খানিকটা। শেষ পর্যন্ত কম ঝালের পাতিচখা বলে বিশুমতি হাতে যা তুলে দিলেন, তা পেট তাতানো আগুন–ঝাল।
পাতিচখা বা চা-পাতার ভর্তা চা–শ্রমিকদের প্রিয় খাবার হয়েছে তিনটি কারণে। সাশ্রয়ী, ঘুম তাড়ায় আর নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় নেই। মায়া হাজরা বলেন, চায়ের কাঁচা পাতা খেলে শরীরে তেজ আসে। তিনি বোঝাতে চাইলেন ক্যাফেইনের কথা।
পাতিচখা তৈরির জন্য শ্রমিকেরা কাজের বিরতিতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যান। চার থেকে পাঁচজনের দল নিজের ঝোলা থেকে বের করেন একেকটি খাদ্যবস্তু। সেই দলের একজন পাতিচখা বানিয়ে ভাগ করে দেন সবার বিছিয়ে রাখা গামছা বা প্লাস্টিকের বাটির ঢাকনায়। খাওয়া শেষে কয়েক ঢোক লবণ মেশানো সেই পানীয় গলায় ঢেলে দেন।
ভোর থেকে প্রায় বিকেল পর্যন্ত বাগানে কাজ করার সময় এই পাতিচখাসহ রুটি বা ভাত হচ্ছে নারী চা–শ্রমিকদের একমাত্র খাবার। শীতকালে পাতা ঝরে, স্বাদও বদলায় কিছুটা। অনেক রকম পরিবর্তন হয় বাগানে। শুধু বদলায় না চা–পাতার সঙ্গে সম্পর্কিত চা–শ্রমিকদের অনেক রকম নির্ভরতার গল্প।