গণ–অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৭৩% অভিযোগ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে গত সাড়ে তিন মাসে অভিযোগ এসেছে ১৮০টির বেশি। এর মধ্যে ১৫৩টি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ৭৩ শতাংশ অভিযোগ এসেছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ১৫ বছরের বেশি শাসনামলে গুম–খুনের ঘটনায় অভিযোগ এসেছে ২৩ শতাংশ।

এই ১৫৩ অভিযোগের মধ্যে ৯৪টিতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ১৪ দলের শীর্ষ নেতা, সাবেক ও বর্তমান আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্য এবং এই ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর রয়েছেন।

প্রথম আলো যেসব অভিযোগ বিশ্লেষণ করেছে, তা গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জমা হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১১১টি, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত গুম–খুনের ঘটনায় ৩৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। অন্য চারটি অভিযোগের একটি মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়ে করা আবেদন।

চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় সূত্র বলছে, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় সরাসরি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যায় না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করতে হয় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে। এই কার্যালয়ের অধীন তদন্ত সংস্থার কাছেও অভিযোগ জমা দেওয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাই–বাছাই করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের অধীন তদন্ত সংস্থা। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন চিফ প্রসিকিউটর।

এখন পর্যন্ত চিফ প্রসিকিউটর সাতটি মামলা করেছেন ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে পাঁচটি মামলা গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। দুটি মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুমের ঘটনায়। সাতটি মামলার মধ্যে একটি মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে গুম-খুন এবং গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তাঁকে এসব অপরাধের প্রধান আসামি বা অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে ১৭ ডিসেম্বর তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

প্রথম আলো যেসব অভিযোগ বিশ্লেষণ করেছে, তা গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জমা হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১১১টি, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত গুম–খুনের ঘটনায় ৩৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে।

গণ–অভ্যুত্থানের আরেকটি মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। এ ছাড়া আসামির তালিকায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও আমলাও রয়েছেন।

আরেকটি মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। আর গুমের দুটি মামলায় একটিতে রাঙামাটির পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুলের সাবেক পুলিশ সুপার মো.মহিউদ্দিন ফারুকীকে এবং আরেকটিতে বরিশাল রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো.আলেপ উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে।

গণ–অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। বিগত সরকারের সময়ে গুম–খুন এবং গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল।

গণ–অভ্যুত্থানের আরেকটি মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা। এ ছাড়া আসামির তালিকায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও আমলাও রয়েছেন।

সাবেক প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ

ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই ধানমন্ডি এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ফারহান ফাইয়াজকে। এ ঘটনায় গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযোগ জমা হয়। ফারহানের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া অভিযোগটি করেন।

জুলাই হত্যাকাণ্ডে মানবতাবিরোধী অপরাধে এখন পর্যন্ত যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়াও রয়েছেন তাঁর বোন শেখ রেহানা। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।

সাবেক মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের, আ ক ম মোজাম্মেল হক, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক, হাসান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, ফারুক খান, শাজাহান খান, মতিয়া চৌধুরী (প্রয়াত), দীপু মনি, কামরুল ইসলাম, মহিবুল হাসান চৌধুরী, জুনাইদ আহ্‌মেদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও কামাল আহমেদ মজুমদার।

জুলাই হত্যাকাণ্ডে মানবতাবিরোধী অপরাধে এখন পর্যন্ত যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়াও রয়েছেন তাঁর বোন শেখ রেহানা। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের মধ্যে রয়েছেন সালমান এফ রহমান ও তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী। আরও আছেন ঢাকার সাবেক দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস।

অভিযোগ এসেছে যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ ও যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মইনুল হোসেন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে।

গুমের অভিযোগে যাঁদের নাম এসেছে

গুম
প্রতীকী ছবি

সরকার পতনের পর গুমের প্রথম অভিযোগটি করা হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর। ইশরাত রফিক নামের একজনকে বেআইনিভাবে আটক ও নির্যাতন করার অভিযোগ আনা হয় তাতে।

জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এনামুল কবিরকে বেআইনিভাবে আটক করে নির্যাতনের ঘটনায় ২৩ সেপ্টেম্বর গুমের দ্বিতীয় অভিযোগটি করা হয়।

গুম–খুনের ঘটনায় যাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (পরে আইজিপি হন) বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, হাসান মাহমুদ খন্দকার ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। এ ছাড়া রয়েছেন র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. মোখলেছুর রহমান, এম খুরশীদ হোসেন ও মো. হারুন অর রশিদ।

আরও রয়েছেন ডিএমপি সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, খন্দকার গোলাম ফারুক ও মোহা. শফিকুল ইসলাম, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রমুখ।

গুমের ঘটনায় সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের নামে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ এসেছে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জমা হওয়া সব অভিযোগই তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা না পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে না।