নিষিদ্ধ বালাইনাশক কার্বোফুরান অক্টোবর পর্যন্ত ব্যবহারের অনুমতি

দেশে এখনো রয়েছে ৩ হাজার ২৮৫ টন। মানবদেহ ও প্রকৃতির ক্ষতি আরও বাড়বে।

বালাইনাশক
প্রতীকী ছবি

কার্বোফুরান নামের বালাইনাশকটি মানুষ তো বটেই, বেশির ভাগ প্রাণীর জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। সেই ২০১৬ সালে জাতিসংঘ এটি নিষিদ্ধ করতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। এরপর এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৮৭টি দেশ বালাইনাশকটি নিষিদ্ধ করেছে।

গত জানুয়ারিতে ৮৮তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এটি নিষিদ্ধ করে। রাষ্ট্রপতির আদেশ অনুযায়ী, গত জুন থেকে এটি আর ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু গত ৩১ জুলাই সরকারের বালাইনাশকবিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির (পিটাক) সভায় আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত কার্বোফুরান ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

কার্বোফুরান মারাত্মক ক্ষতিকর বালাইনাশক হওয়ার কারণেই এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রয়ে যাওয়া বালাইনাশক দ্রুত শেষ করা এবং আমন ও বোরো মৌসুমে যাতে পোকামাকড়ের কারণে খাদ্য উৎপাদন না কমে, সে কথা বিবেচনা করে তিন মাস সময় বাড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ কীটতত্ত্ব সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রুহুল আমীন

পিটাকের সভায় কার্বোফুরানকে মারাত্মক ক্ষতিকর বা এক্সট্রিমলি হ্যাজার্ডাস বালাইনাশক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু দেশের বালাইনাশক কোম্পানিগুলোর কাছে এখনো ৩ হাজার ২৮৫ টন কার্বোফুরান ও এর ৪৮ টন কাঁচামাল রয়ে গেছে। কোম্পানিগুলোর কাছে রয়ে যাওয়া কার্বোফুরান নষ্ট করার কোনো ব্যবস্থা দেশে নেই বলে জানানো হয়। এই পরিস্থিতিতে আগামী আমন মৌসুমে ওই অবশিষ্ট কার্বোফুরানগুলো শেষ করার ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়। সভায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাসসহ কয়েকজন তাতে সম্মতি দেন এবং কোনোভাবেই সময় আর বাড়ানো হবে না বলে জানান।

সভায় সিদ্ধান্ত হিসেবে বলা হয়, ৩০ অক্টোবরের পর কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে কার্বোফুরান পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে নিবন্ধন বাতিল ও চরম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাদের কাছে অবশিষ্ট কার্বোফুরান রয়ে যাবে, তাদের নিজ দায়িত্বে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে তা নষ্ট করতে হবে।

পিটাকের সদস্য ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বিভাগের উপপরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন) রফিকুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানিগুলোর কাছে রয়ে যাওয়া বালাইনাশক আপাতত কোথাও ব্যবহার করা না হলে তা প্রকৃতিতে রয়ে যাবে। তাই এগুলো দ্রুত ব্যবহার করে শেষ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এরপর যদি কারও কাছে থাকে, তাহলে আর ছাড় দেওয়া হবে না।

সাধারণত ধান, গম, ভুট্টার মতো দানাদার শস্যের পোকা দমনে কার্বোফুরান ব্যবহার করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট প্রটেকশন বিভাগ সূত্র বলছে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৪২ হাজার টন বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ থেকে ১০ হাজার টন হচ্ছে কার্বোফুরানজাতীয়। দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বালাইনাশক এটি।

বাংলাদেশ কীটতত্ত্ব সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রুহুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, কার্বোফুরান মারাত্মক ক্ষতিকর বালাইনাশক হওয়ার কারণেই এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রয়ে যাওয়া বালাইনাশক দ্রুত শেষ করা এবং আমন ও বোরো মৌসুমে যাতে পোকামাকড়ের কারণে খাদ্য উৎপাদন না কমে, সে কথা বিবেচনা করে তিন মাস সময় বাড়ানো হয়েছে।

এর আগে ২০১৬ সালেও কার্বোফুরান নিষিদ্ধের ব্যাপারে আলোচনা উঠেছিল। তবে কয়েকটি বালাইনাশক কোম্পানির চাপে তা পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২২ সালে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র বা বিটাকের সভায় এটি নিষিদ্ধের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। অবশ্য কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় এর বিক্রি ও উৎপাদন অব্যাহত থাকে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, দেশে ২৫২টি কোম্পানি কার্বোফুরান আমদানি, বিক্রি ও প্রক্রিয়াজাত করে। দানাদারজাতীয় ওই বালাইনাশক ভেজা মাটিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে উদ্ভিদের শিকড় দিয়ে পাতা, ডাল ও শস্যের মধ্যে প্রবেশ করে। অন্যান্য বালাইনাশক সাধারণত প্রয়োগের পর ৫ থেকে ২০ দিন তা উদ্ভিদে থাকে। কিন্তু কার্বোফুরান থাকে ৩০ থেকে ৬০ দিন। ফলে ভোক্তার শরীরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহিন প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হওয়ার কারণেই বিশ্বের ৮৭টি দেশ কার্বোফুরান নিষিদ্ধ করেছে। সরকার এর আগেও কয়েক দফা নিষিদ্ধের উদ্যোগ নিয়েও কয়েকটি প্রভাবশালী বালাইনাশক কোম্পানির চাপে তা থেকে সরে আসে।

এবারও একই রকমের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে কি না, এই সন্দেহ তুলে ধরে তিনি বলেন, এত ক্ষতিকর একটি বালাইনাশক নিষিদ্ধের পরও ওই দেশগুলোর খাদ্যনিরাপত্তায় কোনো সমস্যা হয়নি। আর নিষিদ্ধের সময়েই চিন্তা করা উচিত ছিল, এগুলো কীভাবে নষ্ট করা হবে। এতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি আরও তিন মাস বাড়ল।