সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে বন্ধ চিনিকল চালুর উদ্যোগের অভিযোগ

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা বন্ধের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় নাগরিক সমন্বয় কমিটি। ঢাকা, ২৯ ডিসেম্বরছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে কোনো মূল্যায়ন ছাড়াই বন্ধ চিনিকল চালুর উদ্যোগ নিয়ে সাঁওতালদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আজ রোববার রাজধানীতে জাতীয় নাগরিক সমন্বয় কমিটির ব্যানারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করা হয়।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে ‘রংপুর চিনিকল চালু করার নামে গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টার প্রতিবাদ’ শিরোনামে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসানে থাকা ওই চিনিকলগুলো চালুর চেয়ে ওই ভূমিতে চাষাবাদ করা সাঁওতালদের সহায়তা করা অধিক লাভজনক।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় সাঁওতালদের ভোগদখলীয় বাগদা ফার্মের ১ হাজার ৮৪২ একর জমি ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য নেয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। রিকুইজিশন অর্থাৎ অফিস আদেশের মাধ্যমে সাময়িক সময়ের জন্য ওই জমি ব্যবহার করতে নেওয়া হয়। চুক্তি অনুসারে, চিনিকল চালু না থাকলে জমির মালিক বিবেচনায় সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে সেই জমি খেসারতসহ ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

দুই দশক ধরে আখ চাষের জন্য ওই জমি ব্যবহৃত হচ্ছে না উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বহু দাবি ও প্রাণ ঝরিয়েও সেই জমি ফিরে পাচ্ছেন না ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এসব মানুষ। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ চিনিকল পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে। ১৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে এক পরিপত্র জারি করে বলা হয়, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য করপোরেশনের অধীনে ৬টি (শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড় ও রংপুর) চিনির কলের আখমাড়াইয়ের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে চিনিকলগুলো তিনটি ধাপে পুনরায় চালু করা হবে। এতে রংপুরের চিনিকল এলাকার সাঁওতাল ও বাঙালি জনগোষ্ঠী উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কগ্রস্ত। ছয় বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান গোনা চিনিকলগুলো কার স্বার্থে আবার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। তিনি বলেন, দেশে বছরে চিনির চাহিদা রয়েছে ২২ লাখ টন। সরকারি চিনিকলগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক উৎপাদন এক লাখ টনের কম। অর্থাৎ বাকি চাহিদা মেটাতে হয় আমদানি করে। তাহলে এত লোকসান দিয়ে কেন চালানো হবে! আখচাষি ও চিনিকলশ্রমিকদের স্বার্থের কথা বলে একটি চক্র অর্থ লোপাটের পাঁয়তারা করছে।

এএলআরডির চেয়ারপারসন ও নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, জনগণের অংশগ্রহণ, জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন—এসব বিষয় বিবেচনা করে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বহু বছর ধরে চিনিকলগুলো অকার্যকর। সরকার কিসের ভিত্তিতে তা চালু করতে চাইছে, সেসব লাভজনক হবে কি না, সম্ভাব্যতা যাচাই করে তা বিবেচনা করা উচিত।

দেশকে ‘ভয়ংকর দুষ্টু আমলা রাষ্ট্র’ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, আমলারা জনবিচ্ছিন্ন। ওই জমিতে সাঁওতালরা তিন ফসলি ফসল ফলাচ্ছে। সেই জমির ওপর এখন নজর পড়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাঁওতাল পল্লিতে ইচ্ছা করে আগুন লাগিয়ে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল। আসলে চিনিকল বিষয় নয়, প্রকল্পের নামে টাকাপয়সার ভাগ–বাঁটোয়ারা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবাদি জমির এক ইঞ্চিতেও স্থাপনা করা ঠিক হবে না।

সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে বলেন, ১ হাজার ৮৪২ একর অব্যবহৃত তিন ফসলি কৃষিজমি সাঁওতাল পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ২০১৬ সালে গোবিন্দগঞ্জে শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডুকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সাঁওতালপল্লিতে ওই হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ ও তাঁর চক্রের লোকজনের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

আরও পড়ুন

গাইবান্ধার আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ সাঁওতালদের জমি দখল করে ইকোপার্ক করতে চাইলে প্রকৃত ঘটনা জানতে সরেজমিন তদন্ত করছিলেন ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অবিদিও মার্ডি। ২০১৪ সালে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ সাজিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। সেই হত্যারও বিচার করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তবারক হোসেইন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) উপদেষ্টা রেজাউল করিম।

প্রসঙ্গত, আয়োজক জাতীয় নাগরিক সমন্বয় কমিটিতে যেসব সংস্থা রয়েছে সেগুলো হলো—এএলআরডি, নিজেরা করি, ব্লাস্ট, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি।

আরও পড়ুন