ব্যথাহীন চাকা মানেই স্তন ক্যানসার নয়

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় গত ৩১ অক্টোবর।

‘ফ্যামিলি হিস্ট্রি স্তন ক্যানসারের রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট বয়সের আগেই যেসব নারীর ঋতুস্রাব শুরু হয় এবং দেরিতে বন্ধ হয়, যাঁরা জন্মনিরোধক বড়ি সেবন করে থাকেন, দেহের স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করেন না, যাঁরা অ্যালকোহল গ্রহণ করেন, তাঁদেরও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি।’

বলছিলেন এভারকেয়ার হাসপাতাল ঢাকার রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আরমান রেজা চৌধুরী। এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার কেন হয়, কীভাবে নির্ণয় করতে হয়, ডায়াগনসিসের বিভিন্ন উপায়, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. আরমান রেজা চৌধুরী। গত ৩১ অক্টোবর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্তন ক্যানসার নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন। প্রথমেই অতিথির কাছে জানতে চান স্তন ক্যানসার সম্পর্কে। ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের শরীরে যখন কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হয়, সেটাকেই ক্যানসার বলে। আর এ ধরনের বৃদ্ধি যদি স্তনে হয়, সেটাকে বলে স্তন ক্যানসার।’

গর্ভাবস্থা কি স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়? উত্তরে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘গর্ভবতী নারীর শরীরে থাকা হরমোনের ম্যানুপুলেশন সুরক্ষিত পদ্ধতিতে বেশ নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই এ সময়ে স্তন ক্যানসার হওয়ার হার কম থাকে।’

স্তন ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট বয়সের পর কারও যদি স্তনে ব্যথাহীন গোটা, বগলের নিচে কোনো ব্যথাহীন চাকা, স্তনের স্কিন বা চামড়া দেবে যাওয়া, লালচে রং ধারণ করা ইত্যাদি হয়ে থাকে, এগুলোকে আমরা এ ধরনের ক্যানসারের লক্ষণ হিসেবে মনে করি। তবে স্তনে চাকা হলেই ক্যানসার হবে, এমন কোনো কথা নেই। তাই চাকা হলেই দুশ্চিন্তা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’

প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণে স্ক্রিনিংয়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘ক্যানসার হওয়ার আগেই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করা দরকার। কারণ, রোগ হওয়ার আগে সেটি নির্ণয় করা গেলে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা যায়।’

সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন এবং এর সঠিক সময় প্রসঙ্গে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের যে লক্ষণগুলো বলেছি, সেগুলো হলো কি না, নির্দিষ্ট বয়সের পর একজন নারী নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখবেন। এমন পরীক্ষাকেই সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন বলে। এটি করতে হয় ২০ বছর বয়সী মেয়েদের মাসিক শেষ হওয়ার দুই দিন পর। যেহেতু ক্যানসার শরীরে ছড়িয়ে পড়লে এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল, তাই আগে থেকে সতর্ক থাকলে নারীরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।’

মেমোগ্রাম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘মেমোগ্রাম মানে হলো স্তনের এক্স-রে। এটার মাধ্যমে টিউমার নির্ণয় করা হয়। সাধারণত ৪০ বছরের কম বয়সী নারীদের এমন পরীক্ষা করতে নিষেধ করা হয়। তাহলে এ বয়সী নারীরা স্তনে কোনো অসংগতি লক্ষ করে কী করবেন? তাঁরা আলট্রাসনোগ্রাম করবেন। পাশাপাশি “এমআরআই অব ব্রেস্ট”করেও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।’

বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয়, ডায়াগনসিস এবং চিকিৎসা-সুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. আরমান রেজা চৌধুরী।

স্তন ক্যানসারের ধরন সম্পর্কে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘এটা অনেক ধরনের হতে পারে। অনেকেই “এফএনএসি”র মাধ্যমে ধরন বের করতে চান। কিন্তু এর থেকে সঠিক ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বায়োপসি পরীক্ষা করতে হয়, যার মাধ্যমে স্তন ক্যানসারের শ্রেণি নির্ধারণ করা যায়। এটি সাধারণত হয়—লুমিনাল এ, লুমিনাল বি, হার-টু পজিটিভ এবং ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার। পাশাপাশি রিসেপ্টর পরীক্ষা করতে হয়। যা থেকে এর ধাপ ও ধরন সম্পর্কে জানা যাবে। এটা নির্ধারণের পরই চিকিৎসা শুরু করতে হবে।’

ক্যানসার চিকিৎসার জন্য টিউমার বোর্ডের গুরুত্ব সম্পর্কে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের পর্যায়টি জানার পর চার পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়—সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোনথেরাপি। মূলত মাল্টিডিসিপ্লিনারি যে বোর্ড রয়েছে, সেখানকার বিশেষজ্ঞরাই চূড়ান্ত চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করেন।’

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত অনকোলজি প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।

স্তন ক্যানসার রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যে কী কী প্রভাব ফেলে? এ বিষয়ে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘স্তন ক্যানসারের রোগীরা মানসিক অবসাদে ভোগেন। যেহেতু এটা দুরারোগ্য ব্যাধি, তাই রোগীর প্রতি তাঁর প্রিয়জনদের বেশি বেশি খেয়াল রাখতে হবে। আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানাতে হবে।’

স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেশ ও বিদেশের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে ডা. আরমান রেজা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এখন বিশ্বনাগরিক। প্রযুক্তির উৎকর্ষে যেকোনো স্থানে চিকিৎসাপদ্ধতির উন্নতি হলে সেটা দ্রুত পৃথিবীর সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া সহজ। তাই সেভাবে দেশ-বিদেশের মধ্যে পার্থক্য আছে বলে মনে করি না। বলা যায়, বাংলাদেশেই এখন আন্তর্জাতিক মানের স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা রয়েছে। শুধু স্তন ক্যানসার নিয়ে সবাইকে সচেতন হওয়া জরুরি। পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও যুগের সঙ্গে হতে হবে আপডেট।’