নবজাতক মৃত্যু
লাফিয়ে বেড়েছে মৃত্যু, ৪ বছরে সর্বোচ্চ
৫৮৬ সরকারি হাসপাতালে ২০২২ সালে ১০ হাজার ৫৩৩ নবজাতক (২৮ দিন পর্যন্ত বয়স) মারা গেছে। খতিয়ে দেখার তাগিদ স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের।
সারা দেশে সরকারি হাসপাতালে চার বছর ধরে নবজাতক মৃত্যুর হার বাড়ছে। তবে ২০২২ সালে তা হঠাৎ করে লাফিয়ে বেড়েছে। গত বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত মোট ৫৮৬টি সরকারি হাসপাতালে ১০ হাজার ৫৩৩ নবজাতক (২৮ দিন পর্যন্ত বয়স) মারা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত এসব হাসপাতালের মধ্যে ৩৩টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ৪৩০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা পর্যায়ের ১০ থেকে ২৫০ শয্যার ১২৩টি হাসপাতাল রয়েছে।
২০১৯ সালের তুলনায় করোনার ব্যাপক সংক্রমণের দুই বছরে (২০২০ ও ২০২১) চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ায় নবজাতক মৃত্যু কিছুটা বেশি ছিল। তবে গত বছর নতুন স্বাভাবিক সময়ে নবজাতকের মৃত্যু কেন এত বেশি বাড়ল, তা খতিয়ে দেখে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সরকারি কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা।
কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনা–পরবর্তী আর্থিক সংকটের কারণে অনেক মা গর্ভকালে পুষ্টি পাননি, প্রসব–পূর্ব সেবা নেননি, যা গর্ভের সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলেছে। আবার অনেক পরিবার খুব জটিল মনে না করলে নবজাতককে চিকিৎসকের কাছে নেন না। এটাও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ৫৮৬ সরকারি হাসপাতালে জীবিত জন্ম নিয়েছে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৭১ শিশু। প্রতি হাজার জীবিত জন্মে প্রায় ২৪টি নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে, যা গত চার বছরে সর্বোচ্চ। ২০২১ সালের তুলনায় এই হার ৩৩ শতাংশ বেশি। গত বছর মৃত অবস্থায় জন্ম নেয় ১৪ হাজার ৮১৬ শিশু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্য কর্মসূচি ও শৈশবকালীন অসুস্থতা বিষয়ে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (আইএমসিআই) কর্মসূচির ব্যবস্থাপক শরীফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য সংগ্রহে আগের চেয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এতে হাসপাতালগুলো সময়মতো তথ্য পাঠাচ্ছে। এ কারণে মৃত্যুর হার বেশি দেখা যেতে পারে। সরকার নবজাতক মৃত্যুরোধে ৫০ জেলায় নবজাতকের বিশেষায়িত সেবাকেন্দ্র (স্ক্যাবু) এবং প্রায় ৪০০টি ক্যাঙারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) সেবা চালু করেছে। সরকারের লক্ষ্য, প্রতি হাজারে নবজাতক মৃত্যু ১২-এর নিচে নামিয়ে আনা।
বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০২০ সালের তথ্যমতে, দেশে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৫।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ অনুসারে, ২০০৭ সালে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে নবজাতক মৃত্যুর হার ৩৭, ২০১১ সালে ৩২, ২০১৪ সালে ২৮ ও জরিপ বছরে ৩০ ছিল।
ইউনিয়ন পর্যায়েও প্রসব, মৃত্যু বেড়েছে
সারা দেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতায় ৩ হাজার ৩৬৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৮৩টি, উপজেলা পর্যায়ে ১২টি ও জেলা পর্যায়ে ৬০টি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র এবং ঢাকায় তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। বিশেষায়িত ৩টি হাসপাতাল বাদে ৩ হাজার ৬১৯টি সেবাকেন্দ্রে গত বছর ৭৫টি নবজাতকের মৃত্যু এবং ৯৩২টি মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে। ২০২১ সালে ৪১টি নবজাতকের মৃত্যু হয়েছিল এবং মৃত শিশু জন্ম নিয়েছিল ৬৬১টি। গত এক বছরে সেবাকেন্দ্রে প্রসবের সংখ্যাও বেড়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (কৈশোর ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা) মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে এত নবজাতকের মৃত্যু হয়নি। আসলে বাড়িতে প্রসব করাতে গিয়ে মা ও শিশুর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে হাসপাতালে আনা হয়। তখন আর কিছু করার থাকে না।
বেসরকারি হাসপাতালে ও বাড়িতে প্রসবের সময় কত নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে এবং কত শিশু মৃত অবস্থায় জন্ম নিয়েছে, তার হালনাগাদ তথ্য সরকারের কাছে নেই।
শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এনআইসিইউয়ের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মা পুষ্টি না পেলে গর্ভের সন্তান অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়। দেশে নবজাতক মৃত্যুর প্রধান প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে—বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে অপরিণত অবস্থায় শিশুর জন্ম, সেপসিস (রক্ত, ফুসফুস, মস্তিষ্কে জীবাণুর সংক্রমণ), নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য সংক্রমণ, হৃদ্যন্ত্র, মস্তিষ্ক, নাড়ি, ফুসফুস, স্বায়ুরজ্জুতে জন্মগত ত্রুটি। এ ছাড়া শিশু জন্মের পর কাঁদতে না পারলে শ্বাসরোধ হয়, ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন যায় না এবং এতে শিশুর খিঁচুনি হয়। তিনি বলেন, নবজাতকের মৃত্যুরোধে মায়ের প্রসব–পূর্ব সেবা ও হাসপাতালে প্রসব করানোর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। একজন মা গর্ভধারণের পর তাঁকে নিবন্ধন করে সরকারি নজরদারিতে আনতে হবে।