চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আড়াই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীকে ঠিকাদারদের মারধরের ঘটনায় মামলা হয়েছে।
মামলায় আসামি হিসেবে ১০ জন ঠিকাদারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ৫ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
গতকাল রোববার রাতে নগরের খুলশী থানায় মামলাটি হয়। সিটি করপোরেশনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মামলা করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংস্থাটির সচিব খালেদ মাহমুদ।
কাজ না পেয়ে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীকে গতকাল বিকেলে নগরের টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে তাঁর কক্ষে ঢুকে মারধর করেন একদল ঠিকাদার। এ ঘটনায় তিন সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিটি করপোরেশন।
খুলশী থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) শেবু বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প পরিচালককে মারধরের ঘটনায় একটা মামলা হয়েছে। থানার উপপরিদর্শক শহীদুর রহমানকে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মামলায় যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন—এসজে ট্রেডার্সের সাহাবুদ্দিন, শাহ আমানত ট্রেডার্সের সঞ্জয় ভৌমিক ওরফে কংকন, মাসুদ এন্টারপ্রাইজের মো. ফেরদৌস, শাহ আমানত ট্রেডার্সের সুভাষ, মেসার্স খান করপোরেশনের হাবিব উল্ল্যাহ খান, মেসার্স নাজিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের মো. নাজিম, মেসার্স রাকিব এন্টারপ্রাইজের মো. ফিরোজ, মো. ফরহাদ, ইফতেখার অ্যান্ড ব্রাদার্সের মো. ইউসুফ ও জ্যোতি এন্টারপ্রাইজের আশীষ।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে অসৎ ব্যক্তিরা অন্যায় সুবিধা নিতে না পেরে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা তাঁর সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক আইন মেনে দরপত্রপ্রক্রিয়া পরিচালনা করায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সিটি করপোরেশনের লাইসেন্সধারী অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন ঠিকাদার প্রধান কার্যালয়ের চারতলায় অবস্থিত প্রকল্প পরিচালকের কক্ষের সামনে জড়ো হন। তাঁরা কক্ষে প্রবেশ করে প্রকল্প পরিচালককে কটাক্ষ করেন। হঠাৎ কংকন, ফেরদৌস ও সুভাষ মিলে প্রকল্প পরিচালকের শার্টের কলার ধরে ঘুষি দেন। তাঁরা তাঁর শার্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলেন, প্যান্টের বেল্ট খুলে ফেলেন। সাহাবুদ্দিন তাঁর শার্টের ভেতর থেকে রড বের করে টেবিলের কাচ ভাঙচুর করেন। তিনি প্রকল্প পরিচালকের মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অফিস সহায়ক তিলক সিংহ তা ঠেকিয়ে দেন।
প্রকল্প পরিচালককে মারধরের ঘটনায় সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তা মনীষা মহাজন ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির।
সিটি করপোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। মারধরে দায়ী ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হচ্ছে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’। আড়াই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায় গত বছরের ৪ জানুয়ারি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীকে গত বছরের ১৪ আগস্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রকল্পের প্রথম ধাপে ৩৭টি ভাগে (লটে) ২২০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল গত নভেম্বরে। প্রকল্পের আওতায় ওভারপাস, রাস্তা, পদচারী-সেতু, কালভার্ট নির্মাণ, গোলচত্বরসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নকাজ হবে।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, প্রকল্পের কাজ নিয়ে পরিচালকের ওপর আগে থেকে ক্ষুব্ধ ছিলেন ঠিকাদারেরা। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রকল্পের দরপত্র নিয়ম মেনেই করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ঠিকাদারেরা চেয়েছিলেন ভাগাভাগি করে নিতে। এ জন্য করেছিলেন তদবিরও। কিন্তু তা মানেননি প্রকল্প পরিচালক। এতে প্রথম ধাপের ২২০ কোটি টাকার কাজেই নিয়মের কড়াকড়িতে বাদ পড়তে যাচ্ছেন বেশ কয়েকজন ঠিকাদার। এটা জেনেই তাঁর ওপর জোট বেঁধে হামলা করেন ঠিকাদারেরা। যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থক।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল দপ্তরের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকালের হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি বিএনপি সমর্থক ঠিকাদার। হামলায় অংশ নিয়েছেন অন্তত ১৫ জন। তাঁদের মধ্যে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ আওয়ামী লীগ সমর্থক ঠিকাদারও আছেন। হামলায় অংশ নেওয়া সঞ্জয় ভৌমিক ওরফে কংকন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাবেক পাঠাগার সম্পাদক। আর ফেরদৌস, সুভাষ ও হাবিব আওয়ামী লীগ সমর্থক।