‘আমার স্বামী তো ছিলেন পোশাক কারখানায় সুপারভাইজার। শ্রমিক আন্দোলনে যাননি, তিনি শ্রমিকনেতাও ছিলেন না। তাহলে কেন তাঁকে গুলিতে ঝাঁজরা করে মেরে ফেলল?’
প্রশ্নটি পোশাকশ্রমিক জালাল উদ্দিনের (৪০) স্ত্রী নার্গিস আক্তারের। জালাল গত বুধবার গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় ‘ছররা গুলিতে’ আহত হয়েছিলেন। গত শনিবার দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
এ নিয়ে বিক্ষোভে গাজীপুরে দুজন পোশাকশ্রমিকের মৃত্যু হলো। গত বুধবার মারা যান পোশাকশ্রমিক আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০)।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের কাছে গতকাল রোববার দুপুরে আহাজারি করছিলেন জালালের স্ত্রী নার্গিস। তাঁর পাশে বসে কাঁদছিল একমাত্র সন্তান জান্নাতুল ফেরদৌস বাকিয়া (৯)। কাঁদতে কাঁদতে নার্গিস বলেন, তাঁর মেয়েটি এত কম বয়সে বাবা-হারা হলো।
এদিকে বিক্ষোভে ভাঙচুরের ঘটনায় শনিবার রাতে ২২৪ জন পোশাকশ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন গাজীপুরের কোনাবাড়ীর তুষুকা গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ। এটি নিয়ে গাজীপুর ও আশুলিয়ায় এ পর্যন্ত ৩৫ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।
গাজীপুরে ২৩ মামলায় আসামি ১৫ থেকে ১৬ হাজার। আশুলিয়ায় ১২ মামলায় আসামি সাড়ে ৩ হাজার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, শ্রমিকদের চলমান বিক্ষোভে গাজীপুরে ১২৩টি কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে।
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের গোলচত্বর ও মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনে গতকাল বিক্ষিপ্তভাবে কয়েক শ পোশাকশ্রমিক বিক্ষোভ করেন। সকাল ৮টার দিকে তাঁদের বিক্ষোভ শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাঁরা মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে গিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শ্রমিকেরা সড়ক ছেড়ে দেন।
গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকার পরিস্থিতি ছিল শান্ত, তবে থমথমে। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টহল দল সেখানে সতর্ক অবস্থায় ছিল। বেশ কিছু কারখানা বন্ধ ছিল। তবে অনেক কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম চলেছে।
এদিকে গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভে ইন্ধন রয়েছে। তিনি বলেন, ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে যাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই বিএনপির কর্মী। বিএনপির কুষ্টিয়ার একজন নেতা গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে গিয়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভে ‘উৎসাহ’ দিচ্ছিলেন বলে উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মজুরির বিষয়ে আরও কোনো দাবি থাকলে বিজিএমইএর নেতাদের সঙ্গে বসে ফয়সালা করা যেত বলে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সেটি না করে তাঁরা (শ্রমিক) এসব করলে নিজেদের যেমন ক্ষতি হয়, দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে, এটা তাঁদের চিন্তা করা উচিত।’
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গত ২৩ অক্টোবর থেকে পোশাকশ্রমিকেরা বিক্ষোভ করছেন। গত মঙ্গলবার পোশাক খাতের জন্য সরকার গঠিত মজুরি বোর্ড সাড়ে ১২ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে, যা আগের চেয়ে ৫৬ শতাংশ বেশি। তবে শ্রমিকেরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম এত বেশি বেড়েছে যে ন্যূনতম মজুরি আগের হারে বাড়ালে তাঁদের চলা কঠিন।
মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষ ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি চেয়েছিল। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছিল, ন্যূনতম মজুরি হতে পারে ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা।
‘তবু কেন গুলি’
স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে, মারা যাওয়া জালাল উদ্দিন ইসলাম গ্রুপের একটি পোশাক কারখানায় সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন।
জালালের স্ত্রী নার্গিস বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো সকালে আমার স্বামী কারখানায় গিয়েছিলেন। আন্দোলনের কারণে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করায় তিনি বাসায় ফিরছিলেন। ঠিক বাসার গলির সামনেই জালালকে গুলি করে ঝাঁজরা করল।’ তিনি আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘কেন আমার স্বামীকে এভাবে মেরে ফেলা হলো? ওরা আমার কলিজা ছিদ্র করেছে। আরেকটা বুলেট মেরে আমার বুকটাও ছিদ্র করে দাও। স্বামীকে ছাড়া সন্তান দিয়ে আমি কীভাবে বাঁচব?’
জালাল নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাঁশাটি ভুটিয়ার কান্দি গ্রামের চান মিয়ার ছেলে। তাঁরা সাত ভাইবোন। গুলিতে বড় ভাইয়ের আহত হওয়ার খবর শুনে দুবাই থেকে সকালে দেশে ফিরে এসেছেন জালালের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম। বিমানবন্দরে নেমেই বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনেন তিনি।
হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ভাতিজিকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সাইফুল বলেন, ‘ভাইকে আর জীবিত দেখতে পেলাম না।’