‘ক্যাডির মেয়ে টিভিতে গাইতে চায়, ব্যবস্থা করো’

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মহাপরিচালক হিসেবে কর্মজীবনের (২০১৬-২০২১) শেষ অধ্যায়টি পার করেছেন হারুন রশীদ। এর আগে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নানা পদে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার বয়ান তিনি দিয়েছেন তাঁর ‘আমলাবেলা’ নামের আত্মজৈবনিক বইয়ে। গত বইমেলায় প্রকাশিত বইটিতে তিনি বিটিভিতে নিজের চাকরির পর্বকে বর্ণনা করেছেন ‘এ যে ভীষণ যন্ত্রণা’ শিরোনাম দিয়ে। এই পর্বের বিশেষ অংশগুলো নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আজ থাকছে প্রথম পর্ব

রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের ভবনছবি: জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) নামের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলটি নিয়ে সাধারণ মানুষের যেন অভিযোগের অন্ত নেই। শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে নন্দিত-নিন্দিত, প্রশংসিত-সমালোচিত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কারও কারও মতে, এই টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মান কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু নিম্ন পর্যায়েরই নয়, তা অসম্মানজনকও। ক্ষমতাসীন সরকারের গুণকীর্তন আর মোসাহেবিতে ভরা যা সম্প্রচার করা হয়, তা দর্শকেরা দেখতে চান না। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে তো এর নামই দেওয়া হয়েছিল ‘সাহেব বিবি গোলামের বাক্স’।

বিটিভিতে হারুন রশীদের প্রথম পদায়ন হয়েছিল ১৯৯৮ সালে অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে। কিন্তু তখন তিনি যোগ দেননি। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, অনেক দিন থেকে তিনি বিটিভিতে নাটক লেখা, অভিনয়, উপস্থাপন প্রভৃতি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সেখানে অনেকের সঙ্গে সখ্য সৃষ্টি হয়েছে। ফলে প্রশাসনিক কাজ করা অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনুধাবন করে সে যাত্রা তাঁকে রেহাই দিয়েছিলেন। তবে ফাঁড়া কাটেনি। ২০০৫ সালে পদোন্নতি লাভ করার পর আবার তাঁকে পরিচালক (প্রশাসন) পদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তবে একই কারণ দেখিয়ে দ্বিতীয় দফায়ও বিষয়টি বাতিল হয়ে যায়।

কিন্তু প্রবাদে আছে, ‘ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন।’ দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর পর নানা ঘাটে ঘুরে আবার এসে তাঁর চাকরির নৌকা ভিড়ল বিটিভির ঘাটেই। এবার একবারে শীর্ষ পদ মহাপরিচালকের দায়িত্বে। ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি যোগ দিয়েছিলেন।

প্রথম তদবির

প্রথম অভিজ্ঞতা কেমন হয়েছিল, সেটি হারুন রশীদের লেখা থেকেই দেখা যাক, ‘যোগদানের কয়েক দিন পর আমাকে ফোন করলেন সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের এক আত্মীয়। তিনি একজনকে একটি অনুষ্ঠান দেওয়ার তদবির করলেন। ইতিমধ্যে আমি ওই অনুষ্ঠানটা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। অত্যন্ত নিম্নমানের অনুষ্ঠান সেটা। যাকে অনুষ্ঠান দেওয়ার জন্য তদবির করা হচ্ছে, সে ওই অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করে। শুদ্ধ তো দূরের কথা, অর্ধশুদ্ধ বাংলাও বলতে পারে না সে। আমি ওই আত্মীয়কে সবিনয় বিষয়গুলো জানালাম এবং বললাম যে মানহীন অনুষ্ঠান আমরা আর করতে চাই না। তিনি আমার কথা শুনে হাসলেন। বললেন, “আপনার কি ধারণা আপনাকে ওখানে মানসম্মত অনুষ্ঠান করতে পাঠানো হয়েছে?”’

‘তার মানে কী? নিউজকাস্টার হিসেবে আমার বয়স বেশি হয়ে যাবে? বিবিসি, সিএনএনের মতো আন্তর্জাতিক চ্যানেলে সিনিয়র লোকজন নিউজ প্রেজেন্ট করে না? অপরাহ উইনফ্রের বয়স কত জানেন?’ ক্ষিপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন ম্যাডাম।

‘আমার তো সে রকমই মনে হয়। মন্ত্রী, সচিব ব্রিফিং দেওয়ার সময় আমাকে তো এমনটিই বলেছেন,’ বলেছিলেন হারুন রশীদ।

পরে সেই নীতিনির্ধারক মহাপরিচালককে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘থাকতে পারবেন না। এ রকম অ্যাটিচিউড ভালো। কিন্তু দেখবেন, শেষ পর্যন্ত কেউ আপনাকে সাপোর্ট করবে না। বিটিভিতে টিকতে পারবেন না বেশি দিন।’

‘ইনুটিভি’

বিটিভির সংবাদের প্রতি সাধারণ দর্শকের আস্থাহীনতা নতুন কিছু নয়। শীর্ষ পর্যায়ের কোনো কোনো রাজনীতিক ও মন্ত্রী পর্যন্ত বিটিভির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বিভিন্ন সময়।

সাবেক মহাপরিচালক হারুন রশীদ লিখেছেন, ‘জনাব তোফায়েল আহমেদ। বাংলাদেশের রাজনীতির এক প্রবাদপুরুষ। কেন জানি না, তিনি বিটিভিকে পছন্দ করতেন না। কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানালে এড়িয়ে যেতেন। একদিন আমি তাঁকে বললাম: “স্যার, বিটিভি কী ত্রুটি করেছে বলুন। আমরা ঠিক করে নেব। আপনি দয়া করে আমাদের দূরে ঠেলে দেবেন না।”’

‘তোমরা তোমাদের মন্ত্রীকে নিয়েই থাকো। বিটিভিকে তো তোমরা ইনুটিভি বানিয়ে ফেলেছ। তোমার সময় এসে এটা আরও বেশি হয়েছে। হবে না কেন? তুমি তো ইনুরই লোক,’ বলেছিলেন তোফায়েল আহমেদ।

হারুন রশীদ লিখেছেন, ‘বুঝতে পারলাম জননেতার ক্ষোভের কারণ। বিষয়টি জানিয়েছিলাম আমি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে। তিনি বলেছিলেন: “এর জন্য তোমাদের বার্তা বিভাগের লোকজন দায়ী। তারা তথ্যমন্ত্রীকে হাইলাইট করতে গিয়ে সিনিয়র মন্ত্রী ও নেতাদের যথাযথ ট্রিটমেন্ট দেয় না।”’

এরপর তথ্যমন্ত্রী ইনু নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘প্রটোকল নিউজে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পর সিনিয়র মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের খবর আমার (তথ্যমন্ত্রী) খবরের আগে যাবে।’

‘নিজেগো এলাকার টিভি, মহল্লার পোলাপানের অধিকার আছে’

তদবির যে কেবল অনুষ্ঠানের জন্য আসে, তা নয়। অনেক সময় চাকরি দেওয়ারও তদবির আসে মহাপরিচালকের কাছে। তেমন একটি ঘটনার বর্ণনা আছে বইটিতে। রামপুরায় বিটিভির কার্যালয়টি পড়েছে জাতীয় সংসদের রামপুরা-গুলশান সংসদীয় এলাকায়। তখন ওই এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন এ কে এম রহমতউল্লাহ। তিনি কেবল সংসদ সদস্যই নন, নবম ও দশম জাতীয় সংসদের তথ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের পদও অলংকৃত করেছিলেন।

২০২৩ সালে ৬০ বছরে পদার্পণ করে বাংলাদেশ টেলিভিশন
ছবি: জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে

বইয়ে হারুন রশীদ উল্লেখ করেছেন, ‘জনাব রহমতউল্লাহ একদিন বললেন: “নিজেগো এলাকার মধ্যে বিটিভি। সে জন্য এলাকার পোলাপান তো চাইবই সেইখানে তারা কিছু করুক। আপনি আপনার নিয়ম অনুযায়ী কাজ করেন।”’ কিন্তু তদবির ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল।

পরিস্থিতি সামাল দিতে মহাপরিচালক যে কৌশল করেছিলেন, সেটি বেশ চমৎকার। একটু উদ্ধৃতি দিই, ‘একটা সময় জনাব রহমতউল্লাহর লোকদের তদবির বেড়ে গেল। এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি একই কথা বললেন। অর্থাৎ এলাকার ছেলেপুলে একটু আবদার করবে, এটাই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে তাঁর সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে আমার। একদিন বললাম: “সেনা সদর, সচিবালয়, পুলিশ সদর দপ্তরও তো কোনো না কোনো সংসদীয় এলাকায় পড়ে। সে জন্য কি ওই সব এলাকার লোকজন ওই সব দপ্তরে তদবির করবে? করতে পারবে?”’

সংসদ সদস্য রহমতউল্লাহ বলেছিলেন, ‘না, তা কেন?’

এরপর আর কিছু বলতে হয়নি মহাপরিচালককে।

সংবাদপাঠিকার জন্য শীর্ষ আমলাদের তদবির

তদবির যে কেবল মন্ত্রী আর রাজনীতিকদের কাছ থেকে আসে, তা নয়। বরং মহাপরিচালক যেসব ঘটনার বয়ান দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, চাকরিরত থেকে অবসরপ্রাপ্ত দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, নীতিনৈতিকতার উচ্চমানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও তদবিরে বরং কয়েক কাঠি সরেস। কয়েকটি ঘটনা এখানে কিছুটা সংক্ষেপে হারুন রশীদের বয়ানেই তুলে ধরা হলো।

এক: মামা-ভাগনি যেখানে...

এক জ্যেষ্ঠ নেতা প্রায়ই ফোনে তাঁর এক ভাগনির অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তদবির করতেন। ভাগনির অনুষ্ঠানের সময় কম হলে বা অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমলে সময় ও সংখ্যা বাড়াতে বলতেন। বিশেষ দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠান দিতে বলতেন। এ ছাড়া বিটিভিরই এক নারী কর্মকর্তাকে বিটিভির সংবাদপাঠিকা হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তিনি। কিন্তু সেই সংবাদপাঠিকার উচ্চারণের মান ছিল খুবই খারাপ। খবর পড়ার সময় মাঝেমধ্যেই তিনি আঞ্চলিক ভাষায় বাক্য বা শব্দ উচ্চারণ করতেন। মারাত্মক উচ্চারণত্রুটির কারণে একসময় তাঁর খবর পড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যস, অমনি এল সেই ঊর্ধ্বতনের ফোন।

সাবেক মহাপরিচালকের ভাষায়, ‘আমাকে ফোন করে ওই পাঠিকাকে সংবাদ শিডিউল দিতে বললেন সিনিয়র নেতা। আমি পাঠিকার সমস্যার কথা বললে তিনি বললেন: “এখন আর ভুল করবে না। আমি ওকে ট্রেনিং দিয়েছি।” আবার খবর পড়তে দেওয়া হলো কর্মকর্তা সংবাদপাঠিকাকে। একদিন আমি নিজে শুনলাম, ওয়েবসাইটকে সে উচ্চারণ করছে “অয়েবসাইট”। ডেকে পাঠালাম। ভুলগুলো ধরিয়ে দিলাম। সে হাসতে হাসতে বলল: “স্যার, আমাদের এলাকায় আমরা তো এভাবেই উচ্চারণ করি।” রাগ সামলাতে পারলাম না আমি। বললাম: তোমাদের এলাকায় তো কন্যাসন্তানকে ফুরি বলা হয়। সে জন্য জাতীয় মাধ্যমে কাউকে অমুকের মেয়ে না বলে অমুকের ফুরি, এ রকম বলবে নাকি?”’

বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোগো

ওই খবর পাঠিকার এরপরও কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাঁর খবর পড়া আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবার তাঁর জন্য তদবির এল চাকরিরত এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার তরফ থেকে। সাবেক মহাপরিচালক লিখেছেন, ‘এবার ফোন করলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বেশ কয়েক দিন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উপর্যুপরি তদবিরে আবারও খবর পড়তে দেওয়া হলো। এবার দেখা গেল ভুল একটু কম করছে। তবে গতিহীন পাঠ এবং নিষ্প্রভ অভিব্যক্তি। কিছুদিন পর ফোন করলেন ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা: “এখন তো ভালোই পড়ছে। ওকে মেইন বুলেটিনে চান্স দাও।” সংবাদ বিভাগ তাঁকে রাত সাড়ে এগারোটার বুলেটিন পড়তে দিল। আবার একদিন ফোন করলেন তিনি: “ওকে মেইন বুলেটিন দিলে না?”’

‘স্যার, এখন মাঝে মাঝে রাত সাড়ে এগারোটার বুলেটিন পড়ছে। ওটা আমাদের অন্যতম প্রধান বুলেটিন,’ বলেছিলেন সাবেক মহাপরিচালক।

সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জবাবে মহাপরিচালককে বলেছিলেন, ‘আমি কি এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকি নাকি?’

দুই: অপরাহ উইনফ্রের বয়স জানেন?

একবার সিভিল সার্ভিসের এক জ্যেষ্ঠ নারী কর্মকর্তার খায়েশ হলো তিনি সংবাদপাঠিকা হিসেবে বিটিভিতে আবির্ভূত হবেন। চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। হাতে অঢেল সময়। সেটাকে সৃজনশীল কাজে লাগিয়ে দেশ-দশের উপকার করতে চান, এ–ই তাঁর সদিচ্ছা। সে কারণেই বিটিভির মানোন্নয়নকল্পে বিস্তর পরিকল্পনা করেছেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি কিছু অনুষ্ঠান নিজে উপস্থাপনা ও সংবাদ পাঠ করে দর্শকদের কৃতার্থ করতে চান। মহাপরিচালক আবদার শুনে আকাশ থেকে পড়লেন (তিনি এসব কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের নামোল্লেখ করেননি)। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে তিনি সবিনয় জানালেন, ‘ম্যাডাম, বিটিভিতে নিউজকাস্টার হিসেবে অডিশন দিতে হলে বয়সের একটা ব্যাপার আছে।’

‘তার মানে কী? নিউজকাস্টার হিসেবে আমার বয়স বেশি হয়ে যাবে? বিবিসি, সিএনএনের মতো আন্তর্জাতিক চ্যানেলে সিনিয়র লোকজন নিউজ প্রেজেন্ট করে না? অপরাহ উইনফ্রের বয়স কত জানেন?’ ক্ষিপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন ম্যাডাম।

গলফ কোর্সে খেলোয়াড়দের সহকারীকে বলা হয় ক্যাডি। ক্যাডির কাজ হলো খেলোয়াড়ের ব্যাগ, গলফ স্টিক ইত্যাদি বহন করা। হারুন রশীদ লিখেছেন, ‘আমি বললাম: “স্যার, আপনি কি মেয়েটির গান শুনেছেন?”’

‘আমি তাঁকে বলতে পারিনি যে ব্রায়ান উইলিয়ামস, ফিয়োনা ব্রুস, এমিলি মেইটলিসদের মতো সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপকেরা তরুণ বয়স থেকে সংবাদ উপস্থাপনা করে এমন দক্ষতা অর্জন করেছেন, এতটা জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান হয়েছেন যে তাঁদের বয়স কত, দর্শকের কাছে তা এখন আর কোনো ব্যাপারই না। অপরাহ উইনফ্রের বয়স সত্তর পেরিয়ে গেলেও তিনি শো করছেন ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে।...একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী বা পুরুষ কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া হঠাৎ একদিন টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ বা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা শুরু করবেন আর দর্শকনন্দিত হবেন, এমন প্রত্যাশা করা বাতুলতা নয় কি? যাহোক, এসব তো আর বলা যায় না। এটা-ওটা বলে শেষ করলাম কথা,’ লিখেছেন হারুন রশীদ।

‘তোমার ভাবি টেলিভিশনে গাইবে’

একবার ভারী এক অদ্ভুত আবদার নিয়ে মহাপরিচালকের দপ্তরে সস্ত্রীক হাজির তাঁর এক বন্ধু। সোজাসাপটা বলেন, বউয়ের শখ টেলিভিশনে গাইবেন। সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এই বন্ধুপ্রবরটি সরকারি চাকরিতে ছিলেন মহাপরিচালকের একই ব্যাচের। সেই সূত্রে বন্ধুত্ব। কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে অসময়ে চাকরি থেকে অবসরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। এর পরের ঘটনা মহাপরিচালকের লেখা থেকে, ‘অকালে অবসরে যাওয়া আমাদের ব্যাচমেট বলল: “দোস্ত, তোমার ভাবি তো গান করে। এত দিন সংসারের ঝামেলায় ব্যস্ত থাকায় সেভাবে গানবাজনা করতে পারেনি। আমিও অবসরে গেছি। এখন থেকে সে তোমার টেলিভিশনে গান গাইবে।” আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। তার সহধর্মিণীকে সিভিল সার্ভিসে আমাদের ব্যাচের কোনো অনুষ্ঠানেও কোনো দিন গান গাইতে দেখেছি বলে স্মরণে এল না। আমাদের ব্যাচের বেশির ভাগ কালচারাল অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকি আমি। বললাম: “দোস্ত, বিটিভিতে গান গাইতে হলে তো শিল্পী হিসেবে অডিশন দিয়ে তালিকাভুক্ত, মানে এনলিস্টেড হতে হয়।”’

‘তো এনলিস্টেড করে নেও। আজকেই অডিশন নিবা?’ তাৎক্ষণিক জবাব ছিল সেই বন্ধুর।

‘দরখাস্ত দিয়ে যাও। অডিশনের সময় হলে ভাবিকে অডিশনে ডাকা হবে।...অনেক চেষ্টা করে তাকে অডিশন প্রক্রিয়া বোঝানো হলো। বুঝলও সে। কিন্তু তারপরও মন ভার করে চলে গেল আমার অফিস থেকে,’ লিখেছেন হারুন রশীদ।

উপদেশ দেওয়া কর্মকর্তাও তদবিরে

কোনো কোনো আমলার মানসিকতা এমন—বিটিভি যেন তাঁদের নিজেদেরই সম্পত্তি। অবশ্য ওপরে ওপরে বিটিভিকে নৈতিকতার উপদেশ দিতেও দ্বিধা করেন না।

এমনই এক কর্মকর্তা মহাপরিচালককে দুষেছেন বিটিভির অনুষ্ঠানের মান নিম্নগামী হওয়ার জন্য। বলেছেন, ‘জাতীয় চ্যানেলটার মান পড়ে গেছে। বিটিভির অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নে কোনো কম্প্রোমাইজ করবে না। তদবিরে বাজে অনুষ্ঠান অ্যালাউ করবে না। অযোগ্য লোকদের এন্টারটেইন করবে না।’

একদিন সেই কর্মকর্তাই মহাপরিচালককে ফোন করে বললেন, ‘আমার ক্যাডি তোমার সাথে দেখা করবে। ক্যাডির মেয়ে টিভিতে গান গাইতে চায়। তুমি ব্যবস্থা করো।’

গলফ কোর্সে খেলোয়াড়দের সহকারীকে বলা হয় ক্যাডি। ক্যাডির কাজ হলো খেলোয়াড়ের ব্যাগ, গলফ স্টিক ইত্যাদি বহন করা। হারুন রশীদ লিখেছেন, ‘আমি বললাম: “স্যার, আপনি কি মেয়েটির গান শুনেছেন?”’

‘না, শুনিনি। ভালো বা মন্দ যে রকমই হোক না কেন, আমার অনারে মেয়েটিকে কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে দিয়ো। বোঝো তো, আমার ক্যাডির মেয়ে,’ বলেছিলেন উপদেশ দেওয়া সেই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন