জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে, সংবিধানে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। গতকাল রোববার সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে অংশীজনদের মতবিনিময়ে এই পরামর্শ উঠে এসেছে। গতকাল বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, তরুণ সংস্কৃতিকর্মী, গবেষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংস্কার কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন ১১ নভেম্বর (সোমবার) থেকে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল পঞ্চম দিনের মতো একাধিক পর্বে মতবিনিময় সভা করে সংস্কার কমিশন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গতকাল বিকেলে মতবিনিময় সভায় সংস্কারের বিভিন্ন দিক নিয়ে মতামত দেন মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান, গবেষক মাহা মির্জা, তরুণ চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিকর্মী সারোয়ার তুষার, সাইয়েদ আবদুল্লাহ, অরূপ রাহী, দীপক কুমার গোস্বামী, আইনজীবী আরিফ খান, ড. সৈয়দ নিজার, সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর, ইমরান মাহফুজ।
এর আগে পেশাভিত্তিক সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নাসরিন বেগম, প্যানেল আইনজীবী চৌধুরী মকিমুদ্দিন কেজে আলী, উপমহাসচিব মো. জামিল উদ্দিন; ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী মো. কবীর হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন, নির্বাহী সদস্য শফিকুল ইসলাম; গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সহসভাপ্রধান অঞ্জন দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহিম চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সদস্য সাবিনা ইয়াসমিন; বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান, ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন, সদস্য এ কে এম রিয়াজউদ্দিন; বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের প্রেসিডেন্ট চৌধুরী আশিকুল আলম, ভাইস প্রেসিডেন্ট খলিলুর রহমান; বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টসের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ মো. শহিদুল ইসলাম; বাংলাদেশ ইন্ডিজেনিয়ারস পিপলস নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড বায়োডাইভারসিটির (বিপনেট) সদস্য জিডিশন প্রধান সুচিয়াং, সদস্য নবদ্বীপ কুমার; পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সদস্য নিরুপা দেওয়ান, সদস্য হরি পূর্ণ ত্রিপুরা মতবিনিময়ে অংশ নেন।
মতবিনিময়ে থাকা একাধিক সূত্র জানায়, গতকালের মতবিনিময়ে কেউ কেউ বিদ্যমান সংবিধান বাদ দিয়ে নতুন করে সংবিধান রচনা বা সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন সংবিধান সংস্কারের কথা। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন, পুনর্লিখন শব্দটি ব্যবহার করা হলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। সংস্কারের কোনো সীমা টানা নেই। পুরো সংবিধানই প্রয়োজনে সংস্কার করা যেতে পারে। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে প্রশ্নও এসেছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সভায় বলেছেন, সংবিধানের সংস্কার বা যেসব প্রস্তাব তৈরি করা হবে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে করা হবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকারই বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে আছে। গণপরিষদ করা বা নতুন সংবিধান রচনা করতে গেলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো তৈরি করার পর নির্বাচিত সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করার পক্ষে, তিনি এমন মত দিয়েছেন। ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ধরনের ঐকমত্য হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান তুলে দিয়ে দলগুলো নির্দিষ্টসংখ্যক নারী প্রার্থী দেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
লেখক, গবেষক মাহা মির্জা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পরামর্শ ছিল গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেটাকে বুঝতে হবে, সংবিধানে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। কৃষকের, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, তাঁদের রুটিরুজির সুরক্ষার নিশ্চয়তার বিধান সংবিধানে থাকতে হবে। তিনি সংবিধানে কর্মসংস্থানের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার—এই বিষয়গুলোকে আরও বিস্তৃত ও সুনির্দিষ্ট করার প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে সরকার চাইলে জনস্বার্থের নাম করে কৃষকের জমি অধিগ্রহণ করে ফেলতে না পারে, কর্মসংস্থান উচ্ছেদ করতে না পারে।
সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছেন তরুণ লেখক সারোয়ার তুষার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান সংবিধান সংস্কার নয়, তিনি নতুন করে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করার দাবি জানিয়েছেন। কারণ, তিনি মনে করেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর এই সংবিধান আর কার্যকর (ভ্যালিড) নেই। তিনি প্রোক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক, নতুন সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করা, প্রধানমন্ত্রীকে অভিসংশনের ব্যবস্থা রাখাসহ কিছু সুপারিশ দিয়েছেন।
মতবিনিময় শেষে মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সংবিধানের ৩ ধারায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’র সঙ্গে ৫০টি জাতিসত্তার মাতৃভাষার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ, ৬ অনুচ্ছেদে জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’ এর বদলে সব নাগরিক ‘বাংলাদেশি’ হবে, এমন বিধান করা, সংবিধানের জাতীয়তাবাদ-সম্পর্কিত ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংবিধানে আদিবাসীদের সমষ্টিগত মালিকানার অধিকার যুক্ত করা, সংবিধান থেকে উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী—এসব শব্দ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।