বিচিত্র শিল্পের সমাহার চিত্রশালায়

প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন শিল্পপ্রেমী দর্শকেরা। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় চিত্রশালায়
ছবি: আশরাফুল আলম

ফাইবার কাচে বানানো সারিবদ্ধ ভাস্কর্যে মায়ের মুখ, নির্মাণ করেছেন শিল্পী জাহিদা আক্তার। পেছনে এঁকেছেন মায়ের নানা সময়ের যন্ত্রণা ও আনন্দের অভিব্যক্তি। বর্ণনায় লিখেছেন, ‘নারীর জীবনে পরিবর্তন আসে একটু আলাদাভাবে। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী, তারপর মা। মায়ের অস্তিত্ব শুধুই নিজের মধ্যে নয়, সমগ্র মানব জাতির। মা হিসেবে প্রতে৵ক মেয়েরই শক্তিশালী এক ক্ষমতা রয়েছে।’ মা ও সন্তানের মাঝে যোগসূত্রের সেতু শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন তিনি। এ শিল্পকর্ম দেখা যাবে জাতীয় চিত্রশালায়।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয়েছে ‘১৯তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ ২০২২’। গত বৃহস্পতিবার সকালে ভার্চু৵য়ালি এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় চিত্রশালায় শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক এ শিল্পসমাবেশ নানা দেশ থেকে আসা শিল্পীদের বিচিত্র সব শিল্পকর্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে। নানা রকম চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, স্থাপনাশিল্প, ভিডিও আর্ট ও পরিবেশনশিল্পের এক মহাযজ্ঞ এই প্রদর্শনী। গত দুই বছর পৃথিবীতে যা কিছু ঘটেছে, শিল্পীর হৃদয়কে যা নাড়া দিয়েছে, শিল্পকর্মগুলোতে উঠে এসেছে সেসব চিন্তা। করোনা, যুদ্ধ, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, দাসত্বের পুনর্ভাস, মানবমুক্তি, শান্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন শিল্পীরা। অভিবাসন, জলবায়ু, প্রকৃতি ও পরিবেশের সংকটময় পরিস্থিতিও এসেছে শিল্পকর্মে।

প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন শিল্পপ্রেমী দর্শকেরা। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় চিত্রশালায়
ছবি: সংগৃহীত

শুক্রবার ছিল, শনিবারেও থাকবে পরিবেশনা

দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে ১ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে পরিবেশনশিল্প বা পারফরমিং আর্ট। শুক্রবারও শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন স্থানে পারফরমিং আর্ট পরিবেশন করেন বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা। শুক্রবার চিত্রশালার তৃতীয় তলায় দেখা যায় জাপানের রিকো সিমিজুর পরিবেশনা। শনিবার পারফরমিং আর্টে অংশ নেবেন বাংলাদেশসহ কঙ্গো, চিলি ও কোরিয়ার শিল্পীরা।

শরণার্থী ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সেমিনার

সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন মুস্তাফা জামান। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে
ছবি: সংগৃহীত

শুক্রবার প্রদর্শনী উপলক্ষে ছিল দুটি সেমিনার। সকালে জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ ‘হোম অ্যান্ড ডিসপ্লেসমেন্ট’ উপস্থাপন করেন শিল্পী ও শিল্পসমালোচক মুস্তাফা জামান। ঘরছাড়া মানুষের গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, কত ভয়াবহ পরিস্থিতি হলে মানুষ নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় অজানায়। যার একটি নিশ্চিত জীবন ও জগৎ ছিল, বাস্তুচ্যুত মানুষের কাছে সেসব স্মৃতি হয়ে যায়। জোর করে বা অন্য যেকোনোভাবে অভিবাসন আজ এক রূঢ় বাস্তবতা। মানুষের ইতিহাস বাস্তুচ্যুতির গল্পে পরিপূর্ণ। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এমনকি রাজনৈতিক কারণে অভিবাসন হতে দেখা গেছে। আর সাম্প্রতিক ইতিহাসে জলবায়ু–সংকটের কারণে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই প্রবন্ধ বাস্তুচ্যুতি প্রসঙ্গে শিল্পীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়।’ প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।

প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন শিল্পপ্রেমী দর্শকেরা। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় চিত্রশালায়
ছবি: সংগৃহীত

একই বিষয়ের ওপর জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে ছিল আলোচনা। এখানে স্বাগত বক্তব্য দেন শিল্প–সমালোচক নজরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন মঈনুদ্দীন খালেদ। শনিবার একই স্থানে রয়েছে দুটি সেমিনার। আলোচনা হবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে। নাজমা খান মজলিসের সভাপতিত্বে এতে আলোচনা করবেন স্থপতি সাইফ উল হক। দ্বিতীয় পর্বে জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আহরার আহমেদের সভাপতিত্বে আলোচনা করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শামসাদ মর্তুজা।    

শিশু প্রাঙ্গণ ও অন্যান্য আয়োজন

শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত মাঠে শিশুদের জন্য করা হয়েছিল মঞ্চ। সেখানে ছবি এঁকেছে শিশুরা। শিশুদের জন্য সেখানে ছিল শিক্ষামূলক পুতুলনাট্য। ছিল শিশুদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে ইসলাম বয়াতির দল পরিবেশন করে কমলা সুন্দরীর পালা।

শিশু প্রাঙ্গণে পরিবেশন করছে শিশুরা। শুক্রবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির মাঠের মঞ্চে
ছবি: সংগৃহীত

পুরস্কার পেলেন যাঁরা

প্রতিবছর এশীয় এই শিল্পকর্ম প্রদর্শনী উপলক্ষে দেওয়া হয় পুরস্কার। এ বছর গ্র্যান্ড পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পী সুশান্ত কুমার অধিকারী, ইয়াসমিন জাহান নুপুর, নেদারল্যান্ডসের হ্যারল্ড স্কোলে। সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের শিল্পী ফারিহা জেবা, জয়তু চাকমা, মামুর আহসান মাহতাব, ময়নুল ইসলাম পল, সুমন চন্দ্র দাস এবং পর্তুগালের এনা সিলভিয়া মালহাডো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। গ্র্যান্ড পুরস্কারপ্রাপ্ত তিন শিল্পীর প্রত্যেককে  পাঁচ লাখ টাকা এবং সম্মানসূচক পুরস্কারপ্রাপ্ত ছয়জনের প্রত্যেককে তিন লাখ টাকা, স্মারক, স্বর্ণপদক ও সনদ দেওয়া হয়। পুরস্কারের জুরি ছিলেন শ্রীলঙ্কার জগৎ ভিরাসিংহে, তুরস্কের নারসেরিন টর, যুক্তরাজ্যের ইয়োনা ব্লাজউইক ও পোল্যান্ডের শিল্পী জ্যারোস্ল সুহান এবং সভাপতি বাংলাদেশের রফিকুন নবী।

দুই শিশুর সঙ্গে ছবি তুলছেন এক শিল্পী
ছবি: আশরাফুল আলম

এ বছর দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশসহ ১১৪টি দেশের ৪৯৩ জন শিল্পী। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের শিল্পী ১৪৯ জন। আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি মাসব্যাপী চলবে এই প্রদর্শনী। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে সবার জন্য।