চাল, আটা ও ভুট্টার দামে রেকর্ড

চাল ও আটার মধ্যে একটির দাম বাড়লে অন্যটির চাহিদা বাড়ে। এখন দুটির দামই চড়া। ভুট্টা বাড়িয়েছে ডিম ও মুরগির দাম।

বাংলাদেশের বাজারে চাল, আটা ও ভুট্টার দামে রেকর্ড হয়েছে। চাল ও আটা দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। আর ভুট্টা গবাদিপশু ও পোলট্রি খাদ্যের প্রধান উপাদান। আবার মানুষের খাদ্যেও ভুট্টার কিছু ব্যবহার রয়েছে। এই তিন খাদ্যের এত মূল্যবৃদ্ধি অতীতে দেখা যায়নি।

খাদ্যের দামে যে রেকর্ড হয়েছে, তা উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তৈরি করা বাংলাদেশের দানাদার খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে। গত সোমবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

ইউএসডিএ বাংলাদেশে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য চারটি কারণকে দায়ী করেছে—আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, জাহাজভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে এ–ও জানানো হয়, বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যগুলোর মোট উৎপাদনে তেমন হেরফের হয়নি। চাল, ভুট্টা ও গমের উৎপাদন এবার লক্ষ্য ছুঁয়ে যাবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে চাল ও গমের আমদানিও হচ্ছে। তবে গম আমদানি কমতে পারে।

‘আমরা অতীতে গবেষণা করে দেখেছি যে সরকারি সংস্থাগুলো চালের উৎপাদন বাড়িয়ে দেখায়। আর চাহিদা কমিয়ে দেখায়। তাদের হিসাবে হোটেল-রেস্তোরাঁয় মানুষ যে ভাত খায়, তা বিবেচনায় আসে না।’
কাজী শাহাবুদ্দিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক

জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, চালের দাম বেড়েছে, এটা ঠিক। তবে আমনের উৎপাদন এবার ভালো হয়েছে। বাজারে ওই চাল এলে দাম আবারও কমতে শুরু করবে। তারপরও দেশে চাল ও গমের সংকট থাকলে বিদেশ থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটানো হবে। তিনি বলেন, দেশে খাদ্যের কোনো সংকট হবে না।

দেশের বাজারে খাদ্য সরবরাহে কোনো সংকট এখনো হয়নি। টাকা থাকলে চাল ও আটা কিনতে পারছে মানুষ। তবে গত মাসে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। এর কারণ চড়া দাম। উল্লেখ্য, শুধু চাল ও আটা নয়, প্রায় সব খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামই বেড়েছে।

চাল

ইউএসডিএ খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনটি তৈরি করতে বাংলাদেশের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), খাদ্য অধিদপ্তরসহ সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য ব্যবহার করেছে। এতে দেখানো হয়, বাংলাদেশের বাজারে গত আগস্টে মোটা চালের কেজিপ্রতি গড় দর ৫৩ টাকায় ওঠে। এরপর সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা কমে ৫০ টাকা হয়। যদিও ২০২০ সালের জানুয়ারির দিকে দাম ছিল ৩২ টাকার আশপাশে।

সরু চালের গড় দাম সেপ্টেম্বরে দাঁড়ায় কেজিপ্রতি ৭৩ টাকা, যা গত এক বছরে ১২ শতাংশ বেড়েছে।

ইউএসডিএর প্রতিবেদনে চালের দাম নিয়ে একটি লেখচিত্র পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছরের আগে চালের সর্বোচ্চ দাম ছিল ২০১৭ সালে। তখনো দামটি কেজিপ্রতি ৫০ টাকার নিচে ছিল।

এদিকে টিসিবির হিসাবে গত এক সপ্তাহে মোটা ও মাঝারি চালের দাম কেজিতে ২ টাকা করে বেড়েছে। মোটা চালের কেজি দাঁড়িয়েছে মানভেদে ৪৮ থেকে ৫৪ টাকা। মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৮ টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বাজারে চালের এ বছর যে দাম দাঁড়িয়েছে, তা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অতীতে চালের দামে ওঠানামা হয়েছে। তবে মানুষের কাছে বিকল্প ছিল আটা। এ বছর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আরও সংকট এ কারণে যে চালের পাশাপাশি আটার দামও অত্যন্ত চড়া। এমনকি চালের দামকে ছাড়িয়ে গেছে আটা। ময়দার দামও ব্যাপক চড়া, কেজি উঠেছে ৬৫ টাকায়।

চালের দাম বেড়ে যাওয়ার অভ্যন্তরীণ কারণ হিসেবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হওয়া ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে বাড়ানোর কারণে সেচ ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। সার ও জ্বালানি তেলের সরবরাহ ঠিক না থাকলে আগামী মৌসুমে উৎপাদন কমতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়।

গম ও আটা

বাংলাদেশে গমের বাজার ও সরবরাহ পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মোট গমের চাহিদার ১৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১২ লাখ টন গম হবে। গত বছর ৭৫ লাখ টন গম আমদানি হয়েছিল। এ বছর তা কমে ৬৫ লাখ টনে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ ২০২২–২৩ বিপণন বছরের প্রথম তিন মাসে চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ গম আমদানি করতে পেরেছে।

আটার দাম নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মার্চ থেকে বাংলাদেশে আটার দাম বাড়ছেই। এর কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ। ভারত রপ্তানি নিষিদ্ধ করার প্রভাবও পড়েছে। যেহেতু চাহিদার বেশির ভাগ গম বাংলাদেশ আমদানি করে, সেহেতু ডলারের মূল্যবৃদ্ধিও গম আমদানিতে ব্যয় বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে গত অক্টোবরে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম দাঁড়ায় ৫৫ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি।

টিসিবির হিসাবে, গত এক মাসে আটার দাম ৫ শতাংশ বেড়ে মানভেদে কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা হয়েছে।

ভুট্টা

বাংলাদেশে বছরে ৭৫ লাখ টন ভুট্টার চাহিদা রয়েছে। দেশে উৎপাদন হয় ৪৮ লাখ টনের মতো। পোলট্রি ও গবাদিপশুর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বাকি ভুট্টা আমদানি করতে হয়। বেশি আমদানি হয় ভারত, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে।

ইউএসডিএ বলছে, গত অক্টোবরে ভুট্টার কেজিপ্রতি দর উঠেছে সাড়ে ৩৪ টাকায়, যা এক বছর আগের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি।

ভুট্টার চড়া দামের কারণে বাংলাদেশে পোলট্রি ও গবাদিপশুর খাদ্যের দাম বেড়েছে। খামারিরা বলছেন, এতে ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। দেশের বাজারে এখন ডিমের ডজনপ্রতি দর ১৪০ টাকা, যা সাধারণত ১০০ টাকার আশপাশে থাকে। অন্যদিকে পোলট্রি মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৮০ টাকা দরে। এর দর সাধারণত ১৩০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে থাকে।

‘এতটা একসঙ্গে বাড়েনি’

দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ইউএসডিএর প্রতিবেদনে বলা হয়, সামগ্রিকভাবে আগস্টে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত ১১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে সরকারের গুদামে আগের চেয়ে বেশি খাদ্য মজুত আছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কাজী শাহাবুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অতীতে গবেষণা করে দেখেছি যে সরকারি সংস্থাগুলো চালের উৎপাদন বাড়িয়ে দেখায়। আর চাহিদা কমিয়ে দেখায়। তাদের হিসাবে হোটেল-রেস্তোরাঁয় মানুষ যে ভাত খায়, তা বিবেচনায় আসে না।’ তিনি বলেন, সমস্যাটি এখনো রয়ে গেছে। দেশে খাদ্যের চাহিদা ও জোগানের একটি সর্বজনগ্রাহ্য হিসাব তৈরি করতে হবে।

কাজী শাহাবুদ্দিন আরও বলেন, চাল ও আটার মধ্যে একটির দাম বেড়ে গেলে মানুষ অন্যটি খাওয়া বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে এর আগে কখনো চাল ও আটার দাম এভাবে এতটা একসঙ্গে বাড়েনি। এ পরিস্থিতি নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে খাপ খাওয়ানো কঠিন।