ইন্টারনেট দেখে ওষুধ খাওয়া কতটা নিরাপদ, কী বলছে গবেষণা
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের অন্তত ৫৮ শতাংশ স্বাস্থ্যগত নানা পরামর্শ নেন ইন্টারনেটে খোঁজে।
ভিডিও শেয়ার করার মাধ্যম ইউটিউবে ‘নেভার গুগল ইয়োর সিম্পটমস’ শিরোনামের গানটি অনেকেই শুনেছেন। সুইডেনের নাক কান গলার চিকিৎসক হেনরিক ইদিগ্রেন এ গান গেয়েছেন। গানে ইন্টারনেট দেখে চিকিৎসা নেওয়ার কুফল সম্পর্কে বলা হয়েছে।
মজা করে এই গানে বলা হয়েছে, ‘তুমি যদি “কফ” ও “ডায়াগনোসিস” লিখে গুগলে খোঁজো, তুমি দেখবে তোমার যক্ষ্মা হয়ে গেছে। যদি “ফিভার”(জ্বর) ও “রেড” দিয়ে অনুসন্ধান করো, তাহলে দেখবে তোমার ইবোলা হয়েছে এবং দ্রুতই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছ।’
ঢাকা বিভাগে ইন্টারনেটে দেখে অসুখের ধরন বোঝার চেষ্টা করা ও সেখানে পাওয়া পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা অনেকের মধ্যে আছে। এ-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৫৮ শতাংশ স্বাস্থ্যগত নানা পরামর্শের জন্য ইন্টারনেটের ওপর নির্ভর করেন। তাঁরা সেই অনুযায়ী ওষুধও খান। এই প্রবণতাকে বলা হয় ‘সাইবারকন্ড্রিয়া’।
অনেকেই ইন্টারনেটে দেখে নিজেরা অসুখ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন বা ওষুধ খান। এই যে বিপুলসংখ্যক মানুষের এই প্রবণতা, এটা চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতার একটি উদাহরণ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অনেকেই ইন্টারনেটে দেখে নিজেরা অসুখ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন বা ওষুধ খান। এই যে বিপুলসংখ্যক মানুষের এই প্রবণতা, এটা চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতার একটি উদাহরণ। দেশের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। এর পাশাপাশি চিকিৎসাব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণও একটা কারণ। এই গবেষণা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির প্রবণতা তুলে ধরছে।
বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজের চিকিৎসার উপায় খোঁজা নিয়ে ‘পজিটিভ পারসেপশন অব সেলফ মেডিকেশন প্র্যাকটিস অ্যান্ড সাইবারকন্ড্রিয়া বিহেভিয়ার অ্যামং অ্যাডাল্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি চলতি মাসে বিভিন্ন গবেষণার ডিজিটাল তথ্যভান্ডার বলে পরিচিত ‘আইইইই এক্সপ্লোর ডিজিটাল লাইব্রেরি’তে স্থান পেয়েছে। গবেষণায় ঢাকা বিভাগে বসবাসকারী প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী) ৪৮০ ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশই অবিবাহিত।
গবেষণার নেতৃত্ব দেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. আমিনুল ইসলাম। সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) শারজা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক আহমেদ হোসেন, সৈয়দ আজিজুর রহমান, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) আনিকা তাসনিম চৌধুরীসহ মোট ১২ জন গবেষক এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।
গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, লক্ষণ দেখে রোগনির্ণয় এবং ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ—ইন্টারনেটে এসব দেখে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। নিজে নিজে রোগ নির্ণয় করতে ভুল করা এবং ভুল ওষুধ সেবন করার ভয়ানক পরিণতির উদাহরণও আছে।
গবেষক মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ নিজে নিজে ওষুধ কেন খান এবং ওষুধ সম্পর্কে খোঁজেন—বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়েই এই গবেষণার চিন্তা মাথায় আসে। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি বিশেষত ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সহজলভ্য হওয়ার কারণেই নিজে নিজে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যে সাইবারকন্ড্রিয়া–প্রবণতা বেশি লক্ষ করেছি।’
সাইবারকন্ড্রিয়া হলো কোনো ব্যক্তির এক বিশেষ ধরনের আচরণ। এ সময় মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তাঁরা একটা নিরাপদ সমাধান খোঁজেন। নিজের অসুখের জন্য স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য পেতে অতিরিক্ত অনলাইনে আসক্ত হয়ে যাওয়া এবং সে জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ না মেনে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতাই হলো সাইবারকন্ড্রিয়া।
গবেষণায় যা পাওয়া গেল
এটা মূলত একটি জরিপনির্ভর গবেষণা। গত বছর (২০২২) থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ জরিপ চলে। বিভিন্ন স্তরভিত্তিক নমুনায়নের মাধ্যমে এই ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট করা হয়। এরপর প্রত্যেকের সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮০ জনের মধ্যে ২৭৯ জনই ইন্টারনেটে স্বাস্থ্য বিষয়ে খোঁজখবর নেন। ইন্টারনেট দেখে ওষুধও খান। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তির মধ্যে ২৮৩ জন ছিলেন পুরুষ। দেখা গেছে, নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে নিজে নিজে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা বেশি।
গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, লক্ষণ দেখে রোগনির্ণয় এবং ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ—ইন্টারনেটে এসব দেখে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। নিজে নিজে রোগ নির্ণয় করতে ভুল করা এবং ভুল ওষুধ সেবন করার ভয়ানক পরিণতির উদাহরণও আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পৃথক জরিপে দেখা গেছে, দেশ দুটিতে যথাক্রমে ৮৮ শতাংশ ও ৫১ শতাংশ মানুষ চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্যের জন্য ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। এখন ইন্টারনেটের প্রসারে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া অনেক সুবিধা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যগত সচেতনতাও বেড়েছে। তবে এর মাধ্যমে নিজে নিজে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
প্রযুক্তি বিশেষত ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সহজলভ্য হওয়ার কারণেই নিজে নিজে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যে সাইবারকন্ড্রিয়া–প্রবণতা বেশি লক্ষ করেছি।
প্রভাব কী
ইন্টারনেটে রোগের লক্ষণ দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও ওষুধ খেতে গিয়ে বড় দুটি সমস্যা হয় বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক বা স্টেরয়েডের অপব্যবহার হতে পারে। মানুষের শরীরে এর প্রভাব মারাত্মক।
চিকিৎসক ও চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি জরিপে উঠে আসা আস্থাহীনতার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, চিকিৎসকদের প্রতি আস্থার সংকট শুধু এ দেশের নয়, বিশ্বের নানা দেশে আছে। এটা কাটাতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।