প্রথম আলো সম্পাদকের জামিন শুনানিতে যেসব বিষয় উঠে এল
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান আগাম জামিন পেয়েছেন। তাঁর করা আবেদনের শুনানি নিয়ে রোববার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ছয় সপ্তাহের জন্য জামিন দেন।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভারে কর্মরত) শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত বুধবার মধ্যরাতে রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি করেন আইনজীবী আবদুল মালেক (মশিউর মালেক)। মামলাটি দায়েরের প্রায় ২০ ঘণ্টা আগে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তাঁর সাভারের বাসা থেকে সিআইডির পরিচয় দিয়ে তুলে আনা হয়। পরে তাঁকে এই মামলায় গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
শামসুজ্জামানের বিষয়ে তাঁর আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার জানান, জামিন আবেদন নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠান আদালত। নিয়মানুযায়ী চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এবং পরে মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করতে হয়। সোমবার আবার তাঁর জামিনের আবেদন করা হবে।
প্রথম আলো সম্পাদক রমনা থানার মামলায় রোববার হাইকোর্টে উপস্থিত হয়ে আগাম জামিনের আবেদন করেন। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বেলা সোয়া তিনটার দিকে শুনানি হয়। জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল। শুনানিতে সহযোগিতায় ছিলেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ইমতিয়াজ মাহমুদ ও প্রশান্ত কুমার কর্মকার। আদালতে উপস্থিত হয়ে আইনজীবী জেড আই খান পান্নাও আবেদনকারীর পক্ষে কথা বলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জী বাপ্পী।
আইনজীবী ফিদা এম কামাল শুনানি শুরু করার পরপরই আদালত মামলায় অভিযোগ কী, সেটা জানতে চান। তখন ফিদা এম কামাল বলেন, একটি পোস্ট নিয়ে একজন আইনজীবী (বাদী) অভিযোগ করেছেন। এতে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ৩১ ও ৩৫ ধারা অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
একপর্যায়ে এজাহারের অংশবিশেষ তুলে ধরে আদালত বলেন, প্রথম আলোর অনলাইনে প্রদর্শিত জাকির নামীয় শিশুর ছবির কথা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। তখন ফিদা এম কামাল বলেন, ছবিটি সবুজের, জাকিরের নয়। সবুজ হচ্ছে ফুল বিক্রেতা। দিনমজুর জাকির বক্তব্য দিয়েছে, এই বক্তব্য শিরোনামে এসেছে। প্রতিবেদনে তাদের আলাদাভাবে বক্তব্য এসেছে। যে অভিযোগ, তা তাৎক্ষণিক সংশোধনও করা হয়। কিন্তু বাদী ভুলবশত আগের জায়গায় রয়ে গেছে। জামিন আবেদনকারী অতি সম্মানীয় সাংবাদিক। অথচ তাঁকে এভাবে হয়রানি করা হয়।
এ পর্যায়ে আদালত আবার মামলায় করা অভিযোগের একটি অংশ তুলে ধরেন। উল্লিখিত অংশে বাদী বলেছেন, ‘একজন লোক স্বাধীনতা দিবসের দিন নিজেকে প্রথম আলোর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তাকে ১০ টাকা দিয়া তার সামনে মাইক্রোফোন ধরে ক্যামেরায় ছবি তুলে, শিশুটিকে ওই ব্যক্তি তার নাম বা কোনো কিছুই জিজ্ঞাসা করে নাই এবং সে কোনো বক্তব্য দেয় নাই। আমি ফারজানা রূপার (একাত্তর টেলিভিশনের প্রতিবেদক) এই প্রতিবেদন দেখে মনে মনে আতঙ্কগ্রস্ত হই এবং আমার মনে পড়ে যে ১৯৭৪ সালে কুড়িগ্রামের বাসন্তী নামে একজন…।’
এরপর আদালত বলেন, বাসন্তীর জন্য তখন কেউ কিন্তু এগিয়ে আসেননি। ফিদা এম কামাল বলেন, যথার্থ। কিন্তু অভিযোগকারীর বয়স যদি এখন ৬১ বছর হয়, তাহলে ১৯৭৪ সালে তাঁর বয়স কত ছিল? তিনি সেটা স্মৃতিতে রাখলেন কীভাবে, এটি অযৌক্তিক।
আদালত বলেন, ‘আমরা যত দূর জানি, প্রথম আলো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে। সত্যের সন্ধানে—এ ধরনের স্লোগান আছে তাদের। আপনারা যদি এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করেন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার একজন পথিকৃৎ। আপনি যদি এ ধরনের…।’
আইনজীবী ফিদা এম কামাল বলেন, ‘আমরা তো ভুল করিনি। বাদী ভুল করে বিকৃত করে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে হয়রানির মামলাটি করেছে—এই দিকটি বিবেচনার জন্য বলছি।’
আদালত বলেন, মামলার বাদী একজন আইনজীবী। তিনি কীভাবে সংক্ষুব্ধ হলেন? ফিদা এম কামাল বলেন, ‘আমি জানি না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে।’
আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মতিউর রহমান একতার সম্পাদক ছিলেন। তিনি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। এখন সর্বোচ্চ প্রচারসংখ্যার পত্রিকা প্রথম আলোর সম্পাদক তিনি। ‘পেটে ভাত জোটে না’—এ কথা বললে স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়?
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী বলেন, ‘আমি নিজেও প্রথম আলোর একজন পাঠক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পত্রিকা, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষের—এ জন্য। কিন্তু এটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আজকে কী কাজটি করেছে?’ তিনি বলেন, সাত বছরের একটি শিশুকে ব্যবহার করে তাকে দশটি টাকা দিয়ে একটি বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে। পরে সংশোধনী দিয়েছে। গত ২৬ তারিখে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। ২৭ মার্চ সংশোধনী দেয়। এর মধ্যে দেশের যা ক্ষতি হওয়ার, তা করেই দিয়েছে।
এ সময় আদালত বলেন, যেহেতু একটা সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার আছে।
পরে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী শুনানি করেন। তিনি বলেন, রাস্তা থেকে একটা ছেলেকে টাকা দিয়ে ছবি তুলে কিছু না বলে তার বক্তব্য দিয়ে দিল। বিষয়টি সরকার বের করেনি, বের করেছে আরেকজন সাংবাদিক।
শুনানি শেষে আদালত আদেশ দেন। পরে আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার সাংবাদিকদের বলেন, আদালত প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিননামা দাখিল করতে বলা হয়েছে।
যেভাবে মামলা ও শামসুজ্জামানকে তুলে আনা হয়
প্রসঙ্গত, গত ২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ‘গ্রাফিক কার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ছবিটি ছিল একটি শিশুর। পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পর অসংগতি নজরে আসে এবং দ্রুত তা প্রত্যাহার করা হয়। সেটা পরে প্রতিবেদন সংশোধন করে সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে উক্তিটি ওই শিশুর; বরং স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।
পরে এ নিয়ে একাত্তর টেলিভিশনে খবর প্রকাশ করা হয়। তারপর বুধবার ২৯ মার্চ ভোর চারটার দিকে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তাঁর সাভারের বাসা থেকে সিআইডির পরিচয় দিয়ে তুলে আনা হয়। এরপর প্রায় ৩০ ঘণ্টা তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে ২৯ মার্চ বিকেলে জানা যায়, শামসুজ্জামানকে তুলে আনার ঘণ্টা দুয়েক আগে তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া। তবে ৩০ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) সকালে পুলিশ শামসুজ্জামানকে রমনা থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ওই মামলা হয় ২৯ মার্চ মধ্যরাতে। এতে প্রথম আলো সম্পাদককেও আসামি করা হয়।
সোমবার আবার শামসুজ্জামানের জামিন আবেদন
ঢাকার সিএমএম আদালত গত বৃহস্পতিবার শামসুজ্জামানের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর তাঁকে প্রথমে নেওয়া হয় কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। পরদিন তাঁকে নেওয়া হয় কাশিমপুর কারাগারে। এরপর শনিবার তাঁকে আবার কেরানীগঞ্জ কারাগারে আনা হয়। বর্তমানে তিনি সেখানে আছেন। তাঁর আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার জানান, সোমবার আবার শামসুজ্জামানের জামিন আবেদন করা হবে। আদালতের সিদ্ধান্তের পর পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।