৫১ মৃত্যুতে কারও দায় নেই

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর এভাবে লাশ বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাফাইল ছবি

১১ মাস আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৫১ জন নিহত হওয়ার মামলার তদন্তে কারও দায় পায়নি পুলিশ। মামলাটি ‘তথ্যগত ভুল’ উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

পুলিশ সূত্র জানায়, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি দুর্ঘটনা। ডিপো কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা ছিল না। একই সঙ্গে ডিপোর বিভিন্ন পর্যায়ের আট কর্মকর্তাকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। এটি গ্রহণের শুনানির জন্য আগামী সোমবার দিন ধার্য রয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম জেলা কোর্ট পরিদর্শক জাকের হোসাইন মাহমুদ।

নিহত ৫১ জনের মধ্যে রয়েছেন বিএম কনটেইনার ডিপোর শ্রমিক মবিনুল হকও। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া এলাকায়। মবিনুলের বড় ভাই মো. ফয়সাল গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। বিচারের আশা করি না।’

অথচ ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মালিকপক্ষ ও তদারকির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো দায় এড়াতে পারে না। আবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটি দায়িত্বে অবহেলার জন্য ডিপো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে।

বিস্ফোরণের ঘটনার তিন দিন পর ৭ জুন সীতাকুণ্ড থানায় ডিপোর আট কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে এই মামলাটি হয়। আসামিরা হলেন ডিপোর মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান, উপমহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) নুরুল আক্তার খান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমান, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (প্রশাসন) নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আবদুল আজিজ, ডিপোর শেডের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী ডিপো ইনচার্জ নজরুল ইসলাম। সীতাকুণ্ড থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফ সিদ্দিকী বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন। আসামিদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয় মামলার এজাহারে।

নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিনিয়োগে বিএম কনটেইনার ডিপো গড়ে ওঠে। এখানে বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপের অংশীদারি রয়েছে।

নিহত ৫১ জনের মধ্যে রয়েছেন বিএম কনটেইনার ডিপোর শ্রমিক মবিনুল হকও। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া এলাকায়। মবিনুলের বড় ভাই মো. ফয়সাল গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। বিচারের আশা করি না।’

পুলিশ সূত্র জানায়, প্রথমে মামলাটি সীতাকুণ্ড থানা-পুলিশ তদন্ত করে। পরে তদন্তভার পায় ডিবি পুলিশ। মামলায় দায়িত্বে অবহেলার কথা উল্লেখ এবং জেলা প্রশাসন ও বন্দরের তদন্তে ডিপো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হলেও পুলিশের তদন্তে ব্যতিক্রম কেন প্রশ্ন করা হলে তদন্ত কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম জেলা ডিবির পরিদর্শক মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘যা হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। আমি ছোট চাকরি করি।’ এর বেশি কিছু বলতে অপারগতা জানান তিনি।

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ গত বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ছুটিতে আছি। এখন কিছু বলতে পারব না।’

পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে নারাজি জানিয়ে পুনরায় তদন্তের আবেদন করা হবে কি না, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিস্তারিত জেনে ধার্য দিনে যা করার করব।’

ওই দুর্ঘটনায় আশপাশে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও শ্রমিকসহ ৫১ জন নিহত হন। এ ছাড়া আহত হন দুই শতাধিক।

নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিনিয়োগে বিএম কনটেইনার ডিপো গড়ে ওঠে। এখানে বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপের অংশীদারি রয়েছে। গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় অবস্থিত বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়। আগুন লাগার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এরপর টানা ৮৬ ঘণ্টা আগুন জ্বলতে থাকে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই দুর্ঘটনায় আশপাশে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও শ্রমিকসহ ৫১ জন নিহত হন। এ ছাড়া আহত হন দুই শতাধিক। বিস্ফোরণে রপ্তানির অপেক্ষায় থাকা ১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার মূল্যের (১৬৭ কোটি টাকা, ডলারের তৎকালীন মূল্য অনুযায়ী) পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই মামলায় পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের নারাজি দিয়ে মামলাটি পুনরায় তদন্তের আবেদন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ দেশে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। পার পেয়ে যাচ্ছে মূল অপরাধীরা। যার কারণে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।

আরও পড়ুন