ক্যানসার চিকিৎসার জন্য কাউকে বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়

সেপ্টেম্বর মাস ক্যানসার সচেতনতার মাস। এ উপলক্ষে ক্যানসারবিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা। অতিথি হিসেবে ছিলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আসমা সিদ্দিকা এবং এসকেএফ অনকোলজির পোর্ট পোলিও ম্যানেজার ডা. মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইসলাম। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয়, ডায়োগনসিসসহ নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। এটি গত মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই ক্যানসার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি সার্ভে অনুসারে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন। তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রায় দুই লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। ধারণা করা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এর সংখ্যা তিন লাখ অতিক্রম করবে।’

এরপর অতিথির কাছে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশে কোন ক্যানসারের হার সবচেয়ে বেশি? উত্তরে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা প্রতিবছর দেড় লাখের মতো নতুন রোগী পাচ্ছি। যেখানে পুরুষ–নারী উভয়ই আছে। সাধারণত পুরুষদের খাদ্যনালি, ফুসফুস, মুখগহ্বর ও স্টমাক ক্যানসারের ব্যাপকতা বেশি। অন্যদিকে নারীদের স্তন, জরায়ুর মুখ, খাদ্যনালি ও ওভারিয়ান ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। তবে নতুন করে উভয়েরই কলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি দেখা দিচ্ছে।’

এ ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে ডা. আসমা সিদ্দিকা জানান, ক্যানসারের মূল কারণ হলো আয়রন। এ ছাড়া লাইফস্টাইল, খাদ্যাভ্যাস, দূষিত পরিবেশ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই বসে বসে কাজ না করে যতটা সম্ভব কায়িক শ্রম, অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা উচিত। তাহলেই ক্যানসারের ঝুঁকি কমানো যাবে।’ ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘নামভেদে ক্যানসারের লক্ষণগুলো ভিন্ন হয়। মোটা দাগে সেগুলো হলো, অতিরিক্ত কাশি, যা চিকিৎসা নেওয়ার পরও ভালো হচ্ছে না, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি বুকে ব্যথা, শরীরে ব্যথামুক্ত গোটা বা চাকা হওয়া, নারীদের মাসিকের সময় ছাড়া অস্বাভাবিক রক্তস্রাব হওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া শরীরে ঘা, যা অনেক দিন ধরে ভালো হচ্ছে না, তিল বা আঁচিলের হঠাৎ করে রঙ–আকৃতি পরিবর্তন হওয়াও ক্যানসারের লক্ষণ। তাই এগুলোর কোনো একটিও যদি দেখা যায়, কোনোরকম অবহেলা ছাড়াই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’

ক্যানসার শনাক্ত হওয়া মানেই কি মৃত্যু? এ প্রসঙ্গে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘একদমই নয়। ক্যানসার হওয়ার পর নির্ভর করে এটি কোন পর্যায়ে আছে। যদি আর্লি স্টেজ মানে পর্যায়–১ ও ২–এ থাকে, তা চিকিৎসায় পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব। সুতরাং ক্যানসারের পর্যায় অনুযায়ী নির্ভর করে রোগী কত দিন ধরে সার্ভাইব করতে পারবেন।’

নারী–পুরুষদের মধ্যে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি? উত্তরে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘পুরুষরাই বেশি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যদিও এর বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা সেভাবে পাওয়া যায়নি। আর স্তন ক্যানসারের মতো নির্দিষ্ট কিছু ক্যানসার আছে, যেগুলো নারীদের বেশি হয়।’

উপস্থাপক জানতে চান, ক্যানসার কি ছোঁয়াচে? উত্তরে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘না। এটি ডিএনএর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে। তাই একজনের ক্যানসার হলে তাঁর থেকে অন্যজনেরও হবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।’

বাংলাদেশে ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয়, ডায়াগনসিস এবং চিকিৎসা-সুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. আসমা সিদ্দিকা (বাঁয়ে)
ছবি: বিজ্ঞপ্তি

রোগনির্ণয় ও স্ক্রিনিংয়ের বিষয়ে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘সাধারণত রোগের লক্ষণ নিয়ে রোগী চিকিৎসকের কাছে আসেন। লক্ষণ দেখে চিকিৎসক বলেন যে তার কী রোগ হয়েছে। এটাকে বলে রোগনির্ণয়। আর কোনো লক্ষণ ছাড়াই চিকিৎসক যে পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কতটুকু আছে, তা নির্ণয় করেন, সেটিকে বলে স্ক্রিনিং। তবে সব ক্যানসারই স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে বোঝা যায় না। ক্যানসারভেদে এর নির্ণয়ও ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই যাঁদের বংশগতভাবে ক্যানসার রয়েছে, তাঁদের নির্দিষ্ট সময় বা বয়সের পর স্ক্রিনিং করাটা জরুরি।’

এরপর উপস্থাপক জানতে চান, ক্যানসার চিকিৎসাব্যবস্থায় জেলাসহ বাংলাদেশের পুরো চিত্রটা কেমন? ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘বাংলাদেশেই ক্যানসারের বিশ্বমানের চিকিৎসা রয়েছে। অর্থাৎ যে মডালিটিতে ক্যানসার চিকিৎসা হয়, তার সম্পূর্ণ আমাদের দেশেই সম্ভব। এর জন্য কাউকে বিদেশ যাওয়ার দরকার নাই। করোনার সময় কিন্তু কেউ বিদেশ যেতে পারেননি। তখন আমরাই চিকিৎসা দিয়েছি। সুতরাং এটা প্রমাণিত।’

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজির সারা দেশে রয়েছে ৩৩টি সেবাকেন্দ্র, যার মাধ্যমে ক্যানসারের ওষুধ পাওয়া যায়। শুধু তা–ই নয়, ঘরে বসে অর্ডার করলেই বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে সহজেই পৌঁছে দেওয়া হয়।

ক্যানসার–চিকিৎসায় বাংলাদেশ ও বিদেশের মধ্যে কী পার্থক্য রয়েছে? এ প্রসঙ্গে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘আমার চোখে যে পার্থক্যটা ধরা পড়েছে, সেটা হলো সমন্বয়। কারণ, ক্যানসার–চিকিৎসাটা একটি টিমওয়ার্ক। সুতরাং সমন্বয় ব্যবস্থাটা উন্নত হলে রোগীরা এর সুফল পাবেন। পাশাপাশি সারা দেশের ক্যানসার রোগীরা যখন ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসেন, চিকিৎসকের ওপর চাপ পড়ে। তাই জেলা পর্যায়ে ক্যানসার চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে এর বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে হবে।’

ক্যানসার নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার বা প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ডা. আসমা সিদ্দিকা বলেন, ‘এ কুসংস্কারগুলো বেশি দেখা যায় নারীদের ক্ষেত্রে। যাঁর ক্যানসার হয় তিনি ভয়ে থাকেন, আমি মনে হয় বাঁচব না। অবিবাহিত নারী বা তাঁর পরিবার চিন্তা করে তাঁর বিয়ে হবে না! এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বাড়ানো এবং সঠিক শিক্ষাটা সবার সামনে তুলে ধরা। আমি মনে করি, আজকের আয়োজনও এ ধরনের কুসংস্কার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’

বাংলাদেশে ক্যানসার–চিকিৎসায় এসকেএফ অনকোলজি কীভাবে ভূমিকা রাখছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে এসকেএফ অনকোলজির পোর্ট পোলিও ম্যানেজার ডা. মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইসলাম বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে আমরা বাংলাদেশে প্রথম হিসেবে বিশ্বমানের ক্যানসার ওষুধ প্রস্তুত করে যাচ্ছি। যেমন স্তন ক্যানসার ও এর সব ওষুধই আমাদের কাছে রয়েছে। ফলে ওষুধের জন্য রোগীদের বাইরের ওষুধের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। বাইরের ওষুধের তুলনায় অর্ধেক বা চার ভাগের এক ভাগ দামে পাওয়ার কারণে রোগীরা আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। এ ছাড়া ইউজিএমপি এবং অ্যানভিজা ব্রাজিলের মাধ্যমে আমরা ইউরোপের প্রায় ২৭টি দেশে এবং আমেরিকার ওই অঞ্চলে ক্যানসারের ওষুধগুলো পাঠাচ্ছি। বিশ্বমানের ওষুধ হওয়ার কারণেই বিশ্বের বাজারে আমাদের ওষুধ চলছে। তাই ক্যানসার–চিকিৎসক, চিকিৎসাব্যবস্থা এবং ওষুধ আমাদের সবই কিন্তু বিশ্বমানের।’