২০২৪ সালেও আমি আশার কথা ভাবি। যদি ভাবতেই হয়, নৈরাশ্যের কথা ভেবে তো কোনো লাভ হবে না। মানব জাতি চিরকাল উন্নত মহত্তর এক জীবনের স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন কখনোই পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। হয়নি বলেই মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্ন রচনা করে, নতুন করে সামনে অগ্রসর হয়।
আজকে আমরা আপন ঘরে বসে যেসব হতাশার কথা ভেবে ব্যথিত হচ্ছি, হয়তো ১৮৯০ সালে লন্ডনের কোনো এক ঘরের কোনায় আমাদের মতো কোনো মধ্যবিত্ত একই কথা বলেছে। আমরা কখনো একটা সমৃদ্ধ জীবনকে একবারে পাইনি। কিন্তু আমরা সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখেছি। এটা দুটো কাজ করেছে। ১. এটা আমাদের পতনের দিকে অত সহজেই যেতে দেয়নি। হয়তো পতন ঘটে গেছে, কিন্তু পতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। ২. আমাদের মধ্যে নিঃশব্দ উন্নতি ঘটেছে।
তাহলে আমরা একটা নতুন বছরে নেতির কথা বলব, নাকি আশার কথা! আমরা আশার কথা বলব। আমরা সামনে তাকাব। এবং প্রতি মুহূর্তে কাজ করে যাব, ভবিষ্যৎ রচনার জন্য অবিরাম কাজ করে যাব।
একটা যুগ উন্নত হচ্ছে মানে সেই যুগের সমস্ত মানুষ মহান বা মহৎ হয়ে গেছে, এটা সত্য নয় কিন্তু। সেই যুগের কিছু কিছু মানুষ সমৃদ্ধ হয়েছে। সেই সমৃদ্ধি থেকে আলো নিয়ে সেই যুগের মধ্যেও কিছুটা সমৃদ্ধি এসেছে। শেক্সপিয়ার, মিল্টন, বায়রন, শেলি, কিটস—এইভাবে যখন বলি, তখন মনে হয়, ৫০ বছরের মধ্যে এঁরা সবাই এসেছেন। তা নয়। অনেক দিন লেগেছিল, অনেক সময়। ইতিহাসের অনেক সাঁকো তাঁদের পার হতে হয়েছে।
অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে ১০০ জিনিয়াস যদি বেরিয়ে থাকেন, তা এক দিনে ঘটেনি। আমরা ভাবি, ৫০ বছরে বা ১০০ বছরে হয়েছে। তা নয়। এক হাজার বছর লেগেছে। আসলে কোনো সময়ই সুসময় নয়। কিন্তু সুসময়ের জন্য আকাঙ্ক্ষা থেকে বড় বড় মানুষের জন্ম হয়েছে। শুধু আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়। একটা যুগেরও স্বপ্ন থাকে। যেমন ব্রিটিশবিরোধী স্বপ্ন থেকে সেই যুগে আমাদের দেশে শুধু রাজনীতিতে নয়, বহু ক্ষেত্রে বড় বড় মানুষ জন্ম নিয়েছেন। এইভাবে আমরা আজকের দিনে এগিয়েছি, এবং পিছিয়েছি। তবে আমি মনে করি, এগোনোর দিকটাই বেশি।
আমাদেরও পতন আছে। আজকে সমস্ত পৃথিবী বিত্তের পেছনে ছুটছে। প্রত্যেক মানুষ সচ্ছল হবে। প্রত্যেক মানুষ অন্তত দারিদ্র্যমুক্ত একটা জীবন যাপন করবে। বিত্তের পেছনে অন্ধের মতো ছুটতে গিয়ে অনেক নৈতিক অধঃপতন ঘটবে। এটা নিয়ম, নদীর একূল গড়লে ওকূল ভাঙবে। একেক যুগে আমরা একটা বড় জিনিস পাব, তার বিনিময়ে আমরা অনেক মহৎ জিনিস হারাব। আবার পরে গিয়ে দেখা যাবে, অন্য জিনিস এসে গেছে। আগে যেটাকে অনেক বড় ভেবেছিলাম, পরে গিয়ে দেখা যাবে, তা তত বড় ছিল না।
২০২৩-এ গাজায় আট হাজারের বেশি শিশু মারা গেছে। এর চেয়ে দুঃখের এই মুহূর্তে কিছু নেই। পৃথিবীকে এই অন্যায় বন্ধ করতে হবে। প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। আবার ১০০ বছরের হিসাবে পরে মনে হবে, হিরোশিমা নাগাসাকিতে আড়াই লাখ মানুষ মারা গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৭ কোটি থেকে ৮ কোটি মানুষ মারা গেছে। গত বছর খবরের প্রধান শিরোনাম ছিল যুদ্ধ; কিন্তু ২০০ বছরের মাপকাঠিতে দেখলে আমরা এখন প্রায় যুদ্ধহীন পৃথিবীতে বসবাস করছি। আগে প্রতিটি দেশ প্রতিটি দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করত, সারা ইউরোপের একটা দেশ আরেকটা দেশকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করত। সেই ইউরোপ এখন একটা ইউরোপে পরিণত হয়েছে।
এটা নিয়ম, নদীর একূল গড়লে ওকূল ভাঙবে। একেক যুগে আমরা একটা বড় জিনিস পাব, তার বিনিময়ে আমরা অনেক মহৎ জিনিস হারাব। আবার পরে গিয়ে দেখা যাবে, অন্য জিনিস এসে গেছে।
যদি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসত, ইউক্রেন যুদ্ধ না হতো, তাহলে কত ভালো হতো! আমি যদিতে বিশ্বাস করি না। একটা প্রবাদ আছে, যদি ‘যদি’ থাকত, তাহলে প্যারিস ‘যদি’র ফাঁক দিয়ে সমুদ্রে পড়ে যেত। আমি বলি, যখন জন্মেছি, তখন সামনের দিকেই এগোতে হবে। আমি একটা লেখা লিখেছিলাম, তাতে বলেছিলাম, মানুষের শরীরটা কি সামনে যাওয়ার জন্য তৈরি না কি পেছনে যাওয়ার জন্য। তাহলে আমাদের চোখ সামনে কেন? নাক-মুখ সামনে কেন? আমরা সামনে পা বাড়াব, হাত বাড়াব, শরীর সেভাবেই তৈরি। চাইলে, দরকার হলে, পেছনেও পা নেওয়া যায়। কিন্তু তা সাময়িক। আসলে সমস্ত অস্তিত্বই সামনে যাওয়ার জন্য।
আমরা কাজ করব, কারণ কাজ মানেই অগ্রগতি। এই বিশ্বচরাচর যে এগিয়ে চলেছে, কারণ প্রতিটা গ্রহ-নক্ষত্র বিরামহীনভাবে কাজ করে চলেছে। সে যেদিকেই যাক, সে সামনের দিকেই এগোবে।
তাহলে আমরা একটা নতুন বছরে নেতির কথা বলব, নাকি আশার কথা! আমরা আশার কথা বলব। আমরা সামনে তাকাব। এবং প্রতি মুহূর্তে কাজ করে যাব, ভবিষ্যৎ রচনার জন্য অবিরাম কাজ করে যাব। যদি বলে কিছু নেই, আমরা যা করব, তা-ই হবে, যদি না করি হবে না!
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র