‘লাইট জ্বালিয়ে দেখি কালো মিচমিচে একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে’
রাতে শুয়ে পড়েছিলেন ৫৫ বছর বয়সী সেলিনা বেগম। পরে ছেলের ঘরে গিয়ে মুঠোফোনে চার্জ দেওয়ার কথা মনে পড়ে। অন্ধকার বারান্দা পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ পায়ে কিছু একটা কামড় বসিয়ে দিল। সেলিনা বলেন, ‘লাইট জ্বালিয়ে দেখি, কালো মিচমিচে একটা সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ভয় পাই। হাতের কাছে লাঠি ছিল, সেই লাঠি দিয়ে সাপটাকে একটা বাড়িও মারি। তখন মেয়ে সাপকে মারতে না করে, বলে, সাপ মারলে শরীর থেকে বিষ আর নামানো যায় না।’ গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে ঘটা ঘটনার বিবরণ এভাবেই দিলেন সেলিনা বেগম।
মাকে সাপে কামড় দিয়েছে, এ কথা শোনার পর বড় ছেলে মোটরসাইকেলে করে রাতের বেলায়ই সেলিনা বেগমকে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
হরিণাকুণ্ডুর ভেড়াখালি গ্রামের সেলিনা বেগম গতকাল মঙ্গলবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে অবস্থায় ছিলাম, সে অবস্থায়ই বড় ছেলে মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিল। হাসপাতালে দুইটা ইনজেকশন দিল। ওরস্যালাইন খাওয়াল। বুকে ব্যথা, ঘুম ঘুম ভাব ছিল প্রথম দিকে। বাড়ি ফেরার পর এখন সুস্থ আছি।’
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন তরিকুল ইসলাম ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সব বর্ণনা শুনে এবং কামড়ের চিহ্ন দেখে সেলিনা বেগমকে কালাচ সাপে কামড় দিয়েছে বলে মনে হয়েছে। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে আনা হয় বলে জটিলতা দেখা দেয়নি। অ্যান্টিভেনম দিতে হয়নি, তবে অন্যান্য যা যা করণীয় বা চিকিৎসা, তা দেওয়া হয়েছে।
সেলিনা বেগমের ছেলে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত সুদীপ্ত সালামের সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, সাপে কাটা বা সাপে কামড় দেওয়া বিষয়ে এলাকায় এখনো অনেক কুসংস্কার আছে। নিজের মায়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, মায়ের পা শক্ত করে বেঁধে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, যা রোগীর ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করে। হাসপাতালে গিয়েও মা সেই বাঁধন খুলতে দিতে চাচ্ছিলেন না। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই হাসপাতালে বসেই ওঝার সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন করণীয় নিয়ে।
তবে সুদীপ্ত সালাম জানান, তাঁর এক আত্মীয় আবদুল্লাহ মারুফ (৪৬) পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে সাপে কাটা রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া, রোগীর স্বজনদের এ বিষয়ে সচেতন করাসহ বিভিন্ন কাজ করছেন। এতে এলাকায় কিছুটা হলেও সচেতনতা তৈরি হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়া রোগীর সংখ্যাও কিছুটা বেড়েছে।
সুদীপ্ত বলেন, কোন সাপ কামড় দিল, সমস্যা বা উপসর্গ কেমন হতে পারে—এসব নিয়ে তেমন কোনো ধারণা না থাকায় মাকে সাপে কামড় দিয়েছে, এটা শোনার পর আবদুল্লাহ মারুফকে ফোনে বিষয়টি জানালে তিনি দ্রুত হাসপাতালে চলে যান। ২৪ ঘণ্টা তিনি হাসপাতালে মায়ের সঙ্গেই ছিলেন।
সুদীপ্ত সালাম জানান, প্রায় এক যুগ আগে তাঁদের বাড়িতে ১৬ বা ১৭ বছর বয়সী এক ছেলে কাজ করত। তাকে সাপে কামড় দিলে সে মারা যায়। এবার মাকে সাপে কামড় দিল। তাই সবার মধ্যে সাপ নিয়ে একধরনের ভীতি কাজ করেছে। এলাকায় সাপের উপদ্রব বেড়েছে। মাকে যে সাপ কামড় দিয়েছিল, সেটাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে একতলা বাড়িতে একটি গর্তের সন্ধান পেয়ে সেই গর্ত ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
তিনি জানান, মা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরার পর ঘরের সব আসবাব বের করে পরিষ্কার করা হয়েছে। আঙিনা পরিষ্কার রাখা হচ্ছে। রাতে ঘুমানোর সময় সবাই মশারি ভালো করে গুঁজে ঘুমাচ্ছেন। যতটুকু সাবধানতা অবলম্বন করা যায়, সবই করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মুঠোফোনে কথা হলো আবদুল্লাহ মারুফের সঙ্গে। তিনি এলাকায় কাউকে সাপে কাটলে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেন। সেলিনা বেগমের কথাও ফেসবুকে জানান। রোগীর শেষ অবস্থাও ফেসবুকে জানানোর চেষ্টা করেন আবদুল্লাহ মারুফ।
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রামনগর গ্রামের আবদুল্লাহ মারুফ এ পর্যন্ত গ্রাম্য ওঝার অপচিকিৎসা থেকে বাঁচিয়েছেন অনেককে। তিনি বলেন, অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হয়নি। অনেককে ওঝার বাড়ি থেকে জোর করে এনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। জানালেন, কাউকে সাপে কাটার পর আশপাশের কয়েকটি উপজেলা থেকেও এখন তিনি ফোন পান। পেশায় ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ মারুফ রোগীর কাছে যেতে যে খরচ হয়, তা নিজেই বহন করেন।
সেলিনা বেগমকে কোন সাপ কামড় দিয়েছে, এটা জানা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে আবদুল্লাহ মারুফ বলেন, সেলিনা বেগম সাপের যে বর্ণনা দিয়েছেন এবং কামড়ের চিহ্ন দেখে মনে হয়েছে, তাঁকে কালাচ সাপ কামড় দিয়েছে। কালাচ খুবই বিষধর। সেলিনা বেগমকে দ্রুত হাসপাতালে আনার ফলে তেমন কোনো জটিলতা দেখা দেয়নি। তিনি হাসিমুখে বাড়িতে ফিরেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর চার লাখ তিন হাজারের বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। এর মধ্যে মারা যান সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ।
হাসপাতালে চিকিৎসা প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ মারুফ বলেন, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা নিয়ে উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখনো ততটা প্রস্তুত নয়। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে কিছুটা তৎপরতা বেড়েছে। তাঁর মতে, হাসপাতালে শুধু অ্যান্টিভেনম থাকলেই হবে না, দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসককে সাপের কামড়ের চিহ্ন ও নানা উপসর্গ দেখে বিষধর সাপ কামড় দিয়েছে নাকি বিষহীন সাপ কামড় দিয়েছে, তা বুঝতে পারার মতো দক্ষ হতে হবে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তাই দক্ষ চিকিৎসক তৈরিতে প্রশিক্ষণের বিষয়টিতে সরকারকে জোর দিতে হবে। সাপে কাটার পর সাপের ধরন অনুযায়ী সময় নষ্ট করা মানেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া।
টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক এম এ ফয়েজ। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, সাপের দংশনের চিকিৎসার জন্য যে ধরনের ওষুধগুলো লাগে, তার একটি হলো অ্যান্টিভেনম। সাপের কামড়ের রোগীর শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে, শ্বাস–প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে, কিডনিতে জটিলতা হতে পারে। এ ছাড়া আরও কিছু শারীরিক জটিলতা হতে পারে, যেগুলোর জন্য রোগীকে আলাদা করে চিকিৎসা বা ওষুধ দিতে হয়। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে সাপে কামড়ানো মানুষদের বেশির ভাগই হাসপাতালে আসতে দেরি করে ফেলেন, যার কারণে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে।
অধ্যাপক এম এ ফয়েজ প্রথম আলোকে জানান, সাপে কাটলেই অ্যান্টিভেনম দেওয়া যাবে না। অ্যান্টিভেনমেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তবে বিষধর সাপ কামড়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে বাংলাদেশে একটিও পরীক্ষা নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই নেই। শুধু রক্ত জমাট বাঁধছে কি না, সেটা পরীক্ষা করা যায়। এ ক্ষেত্রে উপসর্গের ভিত্তিতে চিকিৎসককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।