বাঁশখালীর হিন্দুপাড়ার ১৮ শহীদ স্মরণে ৫২ বছর পর হচ্ছে স্মৃতিসৌধ

চট্টগ্রামের বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ বধ্যভূমিতে নির্মাণাধীন স্মৃতিসৌধ। সম্প্রতি তোলাপ্রথম আলো

১৯৭১ সালের ১৯ মে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কালীপুর ইউনিয়নের হিন্দু পাড়াগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল তা এখনো ভুলতে পারেন না এলাকার প্রবীণ লোকজন। বাঁশখালীর পালেগ্রাম ও কোকদন্ডী এলাকার মানুষদের এখনো সেই স্মৃতি তাড়া করে ফেরে।

সেই রাতে ঘর–বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ওই এলাকার ১৮ জন হিন্দু বাসিন্দাকে ধরে যায় তারা। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ওই গ্রামে বাইরের জেলা থেকে বেড়াতেও এসেছিলেন। সবাইকে জড়ো করা হয় বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজসংলগ্ন পাহাড়ে।

একপর্যায়ে তাঁদের গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। গণহত্যার শিকার ওই ১৮ শহীদের স্মরণে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর নির্মিত হচ্ছে স্মৃতিসৌধ।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ১১ শতক জায়গায় ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন স্মৃতিসৌধ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া কাজটির বর্তমানে প্রায় ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে।

স্মৃতিসৌধে নামফলক বসানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ ১৮ জনের মধ্যে ১৫ জনের নাম কলেজ কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়েছেন। বাকি তিনজনের নাম জানা যায়নি। ওই তালিকায় আছেন শহীদ সরোজ কান্তি দত্ত, জগদিন্দু দত্ত, যোগেশ চন্দ্র পাল, হীরেন্দ্র পাল, পেটান চন্দ্র দে, চিত্তরঞ্জন দাশ, সরোজ কান্তি চৌধুরী, মনোরঞ্জন দে, তারেক চন্দ্র দত্ত, মানিকচন্দ্র পাল, সুরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী, দ্বিজেন্দ্রলাল ভৌমিক, রজনীকান্ত দেবনাথ, অরুণকুমার দেবনাথ এবং শহীদ বিমল কান্তি ঘোষ।

গত মঙ্গলবার সকালে বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজে গিয়ে দেখা যায়, কলেজের প্রশাসনিক ভবনের দক্ষিণ পাশে লাগোয়া স্মৃতিসৌধের অবকাঠামোগত কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। কলেজ মাঠ থেকে স্মৃতিসৌধে প্রবেশের সড়কের কাজটি শেষ হয়নি। গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের নামও উৎকীর্ণ হয়নি।

এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঁশখালীতে বড় ধরনের প্রথম জ্বালাওপোড়াও হত্যাযজ্ঞ চালায় ১৯৭১ সালের ১৯ মে। ওই দিন সকালে স্বাধীনতাবিরোধী স্থানীয় দালালদের সহায়তায় সাঁজোয়া বহর নিয়ে বাণীগ্রাম থেকে শুরু করে নাপোড়া পর্যন্ত অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচার গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। ওই সময় কালীপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ১৮ জনকে হাত-পা বেঁধে বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের দক্ষিণ পাশে গর্তে ফেলে গুলি করে হত্যার পর মাটিচাপা দেওয়া হয়।

ওই বধ্যভূমিতে এর আগে স্মৃতিসৌধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এলাকার লোকজন। গ্রুপ কমান্ডার খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দীনের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে ১৫ মার্চ একটি গণসমাধির ভিত্তি স্থাপন করা হয়। একই বছর ২৬ মার্চ ওই গণসমাধিতে ফলক উন্মোচন করেন বাঁশখালীর তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি সিকদার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জালাল আহমদ। অবশেষে দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে থাকার পর ২০২১ সালে সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও সাধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান কে এম সালাহউদ্দীন কামাল বলেন, ‘২০২১ সালের ৬ অক্টোবর আমি বাঁশখালীর দুটি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করি। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং একটিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণকাজ শুরু হয়। অপর বধ্যভূমিতেও ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলছে।’

স্মৃতিসৌধের ৫ শতাংশ কাজ শেষ হলে সেখানে শহীদদের তালিকা স্থাপন করা হবে বলে জানান বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ফারুখ। তিনি বলেন, কাজ অসম্পূর্ণ আছে। পুরো কাজ শেষ হলে এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের গণহত্যার ঘটনাটি এখনো স্থানীয় লোকজন ভুলতে পারেননি বলে জানান মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া থানার দায়িত্বরত বিএলএফ কমান্ডার আবু ইউসুফ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সেদিন ভয়াবহ ও নারকীয় ঘটনা ঘটায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ওই ঘটনার পর আমরা আর পেছনে তাকাইনি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম স্বাধীনতাসংগ্রামে।’

জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, বাঁশখালীতে চিহ্নিত দুটি বধ্যভূমির মধ্যে একটিতে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াসহ ভূমি জটিলতা কেটে গেলে অপরটির কাজও শিগগিরই শুরু হবে।