সংলাপের সম্ভাবনা আবার নাকচ করলেন প্রধানমন্ত্রী

যারা অগ্নিসন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তপনা করে, তাদের ধরিয়ে দিতে দেশবাসীর প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান।

জাতীয় সংসদে সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সংসদে
ছবি: বাসস

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের সংলাপের সম্ভাবনা আবারও নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘এই সন্ত্রাসী, জঙ্গি, এ অমানুষগুলো, এদের সঙ্গে কারা থাকে, আর তাদের সঙ্গে বসা? এই জানোয়ারদের সঙ্গে বসার কথা কারা বলে? আমার কথা হচ্ছে, জানোয়ারদেরও একটা ধর্ম আছে। ওদের সে ধর্মও নাই। ওদের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ববোধ নেই। ওরা চুরি, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ছাড়া কিছুই জানে না।’

গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কিছু সময় আগে জাতীয় পার্টির (জাপা) সংসদ সদস্য ও দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক আগামী নির্বাচন নিয়ে সংলাপের আয়োজন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। জাপার মহাসচিব বলেছিলেন, ‘জাতির পিতার কন্যা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অনেক দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, কে কী বলল, কী সমালোচনা করল—এগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বিষয়ে এক টেবিলে আলোচনা করার জন্য উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানানো, দেশের মানুষ এ জিনিসটা চাইছে।’

গতকাল ছিল একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। রাতে অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপি যে তাণ্ডব করেছে, সে দৃশ্যগুলো সহ্য করা যায় না। এর বিপরীতে বর্তমান সরকার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি প্রশ্ন রাখেন, দেশবাসী কোন বাংলাদেশ চায়, এই ধ্বংসস্তূপ নাকি উন্নত বাংলাদেশ?

নিজের বক্তব্যের মধ্যে ২৮ অক্টোবর পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার একটি ভিডিও চিত্র সংসদে দেখান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিডিও চিত্র প্রদর্শনের পর তিনি বলেন, ‘কোন বাংলাদেশ আমরা চাই? দিনরাত পরিশ্রম করে মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে যে বাংলাদেশ আমরা উন্নত করেছি, বলেছিলাম দিনবদলের সনদ। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আর তখন এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ।’

বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তা থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবস্থা যখন আমরা করে যাচ্ছি, তখন কী দেখলাম? কথা নেই, বার্তা নেই, নির্বাচন হতে দেবে না। আর আমাকে পদত্যাগ করাবে। ক্ষমতা থেকে হটাবে...এই ঘোষণা দিয়ে গত ২৮ অক্টোবর যে তাণ্ডব করছে বিএনপি সারা বাংলাদেশে...।’

২৮ অক্টোবরের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পুড়িয়ে মানুষ হত্যা না, শুধু মনে হচ্ছে এরা পুরো দেশটাকে ধ্বংস করবে।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘২৮ তারিখে যেভাবে পুলিশকে ফেলে দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, কোন মানুষ এ রকম করতে পারে? ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তারা একইভাবে করেছে। মাঝখানে একটু থেমেছিল, তারপর আবার ভয়ংকর রূপ জাতি দেখছে।’

‘কিলার হায়ার করে মারার চেষ্টা’

বাংলাদেশ নিয়ে কেউ যেন খেলতে না পারে, সে জন্য দেশবাসীর সহায়তা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যারা অগ্নিসন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তপনা করে, তাদের ধরিয়ে দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে হাত দিয়ে গাড়ি পোড়াবে, সেই হাত পুড়িয়ে দিন। তাহলে ওরা থামবে। তা না হলে ওরা থামবে না। এটা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করতে হবে। দেশের মানুষের সহযোগিতা পেলে এদের দুর্বৃত্তপনা কমানো যাবে।’

বারবার আঘাত এসেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিদেশেও আমার ওপর হামলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। আমি বিস্তারিত বলব না। শুধু এইটুকুই জানিয়ে রাখলাম। আমি যখন বিদেশ যাই, সেখানেও কিলার হায়ার করে আমাকে মারার চেষ্টা...সে চেষ্টাও ওই খালেদা জিয়ার ছেলে (তারেক রহমান) যেটা লন্ডনে বসে আছে। সেসহ তাদের যারা সন্ত্রাসী তারাই…। তবে আমি কখনো এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না। জন্মালে তো মরতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত। আর খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতা–কর্মীকে হত্যা করেছে।

সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ছিল বলেই দেশের উন্নয়ন হয়েছে। সেটাকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ওরা (বিএনপি)। কাজেই আমি দেশবাসীকে বলব, তারা কোন বাংলাদেশ চায়। ধ্বংসের স্তূপ নাকি উন্নয়নের বাংলাদেশ। তাদের জীবনমান যে উন্নত হয়েছে, সেটা যদি ধরে রাখতে চান, একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সেটা হবে। নৌকা মার্কাই পারে উন্নত জীবন দিতে। ওরা ধ্বংসই দিতে পারে।’

দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি জিনিসপত্রের দাম নিয়ে অনেকে হা–হুতাশ করছেন। কিন্তু আমরা এই যে উৎপাদন বাড়ালাম। জনসংখ্যা কিন্তু এত গুণ বাড়েনি। তাহলে এগুলো গেল কোথায়? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে।’

শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২০০৬ সালে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তিন দফায় মজুরি বৃদ্ধি করে ৮ হাজার টাকায় উন্নীত করেছে।

সংসদে দেওয়া সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য খাত, বাজেট বৃদ্ধি, জিডিপির আকার বৃদ্ধি, শিক্ষা খাত, দারিদ্র্য বিমোচন, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধি, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, সরকারি সেবা সহজীকরণ, সামাজিক সুরক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিসহ বিভিন্ন খাতে নেওয়া সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।

অধিবেশনের সমাপ্তি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘শেষ অধিবেশনে আমার বক্তব্যের শেষে এইটুকু আহ্বান জানাব, জনগণ হচ্ছে শক্তির উৎস। আমার একমাত্র শক্তি বাংলাদেশের জনগণ। জনগণের শক্তি নিয়েই আমরা চলছি।’

বিরোধীদলীয় নেতাসহ সব সংসদ সদস্যকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চলতি সংসদে ১৬৫টি আইন পাস হয়েছে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এসব আইন নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেকর্ডকৃত একটি ভাষণ সংসদে শোনানো হয়। এরপর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী একাদশ জাতীয় সংসদের ২৫তম ও শেষ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে চলতি সংসদের অধিবেশন–সংক্রান্ত কার্যক্রম শেষ হলো। স্পিকারের ঘোষণার পর সংসদ সদস্যদের অনেকে নিজের আসন ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসনের সামনে ও আশপাশে ভিড় করেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। কেউ কেউ সেলফিও তোলেন।