বিষধর রাসেলস ভাইপার ৩২ জেলায়

মানুষ খেয়াল না করে কাছাকাছি গেলে, সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করে।প্রতীকী ছবি

চন্দ্রবোড়া সাপ বা রাসেলস ভাইপার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। গত ১১ বছরে এই বিষধর সাপ ৩২টি জেলায় দেখা গেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, চন্দ্রবোড়ায় কামড়ানো রোগী বাড়ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় চন্দ্রবোড়া সাপের ব্যাপারে আতঙ্কিত না হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ভেনম রিসার্চ সেন্টার গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পুরোনো ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে এই সাপ থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেই জায়গার ছবিতে সাপ দেখানো হচ্ছে এবং এই সাপের যে প্রজাতির অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই, সেগুলোর ছবি প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে কোনো পোস্ট দেওয়ার আগে জেনেবুঝে তা করতে বলেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এই বিশেষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।

চন্দ্রবোড়া বিষধর সাপ। এর গায়ের রং বাদামি বা হলুদ অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ। সারা দেহে সারি দিয়ে থাকে গোলাকৃতি বা ডিম্বাকৃতি গাঢ় বাদামি ফোঁটা। ফোঁটার সারি দেখে মনে হবে শিকল। সাপ গবেষকেরা বলেছেন, সব সাপই ডিম পাড়ে, সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। চন্দ্রবোড়ার ডিম ফোটে পেটের মধ্যে। পেট থেকে বাচ্চা বের হয়। পানিতে চলাচল এই সাপের পছন্দ।

কোথায় এই সাপ

১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সাপ’ বইয়ে বন্য প্রাণিবিশেষজ্ঞ মো. আলী রেজা খান বলেছেন, চন্দ্রবোড়া সাপ রাজশাহী বিভাগে সর্বাধিক পাওয়া যায়। অন্যত্র আছে, তবে তেমন দেখা যায় না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার বলেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৯টি জেলায় চন্দ্রবোড়া সাপ দেখা গেছে। ২০১৮ সালে এই সাপ থাকা জেলার সংখ্যা বেড়ে হয় ১১টি। ২০২৩ সালে ২৩টি জেলায় এই সাপ নথিভুক্ত করেছিলেন ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকেরা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জেলার সংখ্যা আরও বাড়ে।

২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ৩২টি জেলায় এই সাপ দেখা গেছে। জেলার তালিকায় আছে: নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও বরগুনা।

পদ্মা নদী ও তার শাখা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে চন্দ্রবোড়ার বিস্তার সবচেয়ে বেশি বলে দাবি করেছে ভেনম রিসার্চ সেন্টার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী সাপের বিষ নিয়ে গবেষণায় যুক্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সাপ ভালো সাঁতার কাটতে পারে। নদীপথে এই সাপ ছড়ায়। মেহেরপুর, চুয়াডঙ্গার মতো এলাকাতেও এই সাপ কীভাবে পৌঁছাচ্ছে, তা গবেষণার দাবি রাখে।

রোগীও বাড়ছে

চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো একজন রোগী শনিবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি ছিলেন। ওই রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন রাজশাহী মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। ২০১৩ সালে তিনি প্রথম চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসা করেন। প্রথম আলোকে তিনি জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তিনি ২৩৫ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন, যাঁরা চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগী ছিলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে এসব রোগীর ২৯ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে।

এখন কি রোগী বাড়ছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগী বাড়ছে। পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট। ২০২২ সালে রাজশাহী মেডিকেল চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো ৩১ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ভর্তি হয়েছিল ৫০ জন।’ তিনি আরও জানান, রাজশাহী মেডিকেল সবচেয়ে বেশি রোগী আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে। রোগীদের বড় অংশ ধানের মাঠে দংশনের শিকার হয়।

চন্দ্রবোড়া বাড়ছে কেন

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চন্দ্রবোড়া সাপ কবে প্রথম দেখা গিয়েছিল, সেই ইতিহাস অজানা। তবে সাম্প্রতিক কালে এই সাপ কেন বাড়ছে, তার সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে না। বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, ‘গুইসাপ, বেজি, প্যাঁচা, চিল ও বাজপাখি—এদের শিকার ছিল চন্দ্রবোড়া। এখন গুইসাপ, বেজি, প্যাঁচা, চিল ও বাজপাখি কমে গেছে বা কোথাও কোথাও নাই বললেই চলে। প্রধান শত্রুগুলো কমে যাওয়াই চন্দ্রবোড়া বৃদ্ধির কারণ বলে আমরা মনে করছি। তবে আরও গভীর অনুসন্ধান দরকার।’

দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনের একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। ওই ভিডিও বার্তায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের কয়েকটি জেলায় ও চরাঞ্চলে বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি দেখা গেছে, এতে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করছে। তবে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ‘অ্যান্টিভেনম’ বা সাপে কামড়ের রোগীর চিকিৎসার ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিষধর সাপে কামড়ালে বাঁচার পথ একটাই, রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া। রোগীর চিকিৎসায় ওঝা বা ঝাড়ফুঁক থেকে দূরে থাকার অনুরোধ জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় শনিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে সাপের কামড় এড়াতে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, চন্দ্রবোড়া দেখা দেছে, এমন এলাকায় মাঠে কাজের সময় বুট (জুতা) ও লম্বা প্যান্ট পরতে হবে, রাতে চলাচলের সময় টর্চলাইট ব্যবহার করতে হবে, পতিত গাছ–লাকড়ি–খড় সরানোর সময় সতর্ক থাকতে হবে, সাপ দেখলেই তা ধরা বা মারার চেষ্টা করা যাবে না, প্রয়োজনে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করতে হবে।

চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগী চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা থেকে রাজশাহী মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে যে অ্যান্টিভেনম আছে, তা চন্দ্রবোড়ার বিষ নিরাময়ে কার্যকর। যারা দেরিতে হাসপাতালে এসেছে, তাদের অবস্থা খারাপ হতে দেখেছি। সুতরাং সাপে কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বা যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে আসতে হবে।’