বিশ্বের ১০০টি দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা চালু আছে। তবে একেক দেশে এটি একেক রকম। কোথাও পুরোপুরি সংখ্যানুপাতিক, কোথাও আংশিক বা মিশ্র ব্যবস্থা। আবার কোনো কোনো দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা আছে। বাংলাদেশে প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থা কোনো দলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তৈরি করে দেয়। তাই আংশিক হলেও দেশে শুরু করা যায় সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন।
‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন: অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের ঝুঁকি না সম্ভাবনা?’ শীর্ষক মেরামত আলাপ-২–এ এসব কথা বলেন বক্তারা। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আজ শনিবার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘ভয়েস ফর রিফর্ম’। রাষ্ট্র সংস্কারের সহযোগিতার লক্ষ্যে গত সেপ্টেম্বরে এই প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করে। এর পর থেকে ‘মেরামত আলাপ’ নামে সংলাপ করছে তারা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, কোনোরকমে ক্ষমতায় যাওয়ার যে নির্বাচন, সেটা তো আইনে নেই। তাই পরীক্ষামূলকভাবে হলেও আনুপাতিক নির্বাচন শুরু করা যায়। এখন শুরুটা তো করা যায় অন্তত। এতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়তে পারে। দলগুলোকে বাধ্য করতে হবে নারীদের মনোনয়ন বাড়াতে।
রওনক জাহান আরও বলেন, সংবিধানের মূলনীতি বজায় রেখে এটি সংস্কার করতে হয়, না হলে এটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ’৭২–এর সংবিধান তৈরির সময় ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল। সংস্কারেও ঐকমত্য লাগবে, যেটি এখন দেখা যাচ্ছে না। এটাই বড় তফাত। তিনি বলেন, কমিশন একটা প্রস্তাব তৈরি করে যদি বলে ঐকমত্য হয়ে গেছে, তাতে হবে না। এ ছাড়া আইন ও সংবিধানের জন্য স্বৈরাচার তৈরি হয়নি। বরং আইন ও সংবিধান বাদ দিয়েই এটা হয়েছে, যার জন্য কখনো শাস্তিও হয়নি। তাই নতুন সংবিধান বা ভালো আইন তৈরির চেয়ে এর চর্চা জরুরি।
কোনোরকমে ক্ষমতায় যাওয়ার যে নির্বাচন, সেটা তো আইনে নেই। তাই পরীক্ষামূলকভাবে হলেও আনুপাতিক নির্বাচন শুরু করা যায়। এখন শুরুটা তো করা যায় অন্তত।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম বলেন, আনুপাতিক পদ্ধতি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নিশ্চিত করতে পারে। দেশে শুরুতে মিশ্র পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেলে পরে পুনর্বিন্যস্ত করা যাবে। মানুষ বিষয়টি বুঝে গেলে ওইভাবেই ভোট দেবে, যাতে তার পছন্দের দল ক্ষমতায় আসতে পারে। এতে বহুদলীয় জোট সরকার না–ও হতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ’৭২ সালে এক ব্যক্তিকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত চেতনায় সংবিধান তৈরি করা হয়েছে। এটি যে ক্ষমতাকাঠামো তৈরি করেছে, সেটি স্বৈরাচারের জন্ম দিয়েছে। এটা বদলাতে হবে। তিনি বলেন, আনুপাতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ছোট দলগুলোরও প্রতিনিধিত্ব আসতে পারে সংসদে। আনুপাতিক নির্বাচন বড় দলগুলো মেনে নেবে না। তবু এ দাবি ছাড়া হবে না। রাজনীতি শেষ পর্যন্ত শক্তি ভারসাম্যের খেলা। দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে দুই কক্ষের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে হবে।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান (এনডিএম) ববি হাজ্জাজ বলেন, আনুপাতিক হারে জোটগত সরকার তৈরির সুযোগ বেশি থাকে। তাই সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। এ কারণে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ করা যেতে পারে। উচ্চ কক্ষ হবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। আর নিম্নকক্ষে প্রতিনিধিত্ব হবে দেশের প্রচলিত নির্বাচনপদ্ধতিতে।
সংবিধানবিশেষজ্ঞ সিনথিয়া ফরিদ বলেন, ইসরায়েলে সরকার গঠিত হয় পুরোপুরি আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনে। এতে ডানপন্থীদের থামানো যায়নি, তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা তৈরি হয় ভোটে। বাংলাদেশে ডানপন্থীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে কি না, সেটি ভোটারদের ওপর নির্ভর করবে। দেশে আনুপাতিক নির্বাচন চালু হলে সরকার স্থিতিশীল না–ও হতে পারে; মেয়াদের আগে সরকার ভেঙে যেতে পারে জোটের বিরোধের কারণে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রাজনীতিক সৈয়দ হাসিব উদ্দিন হোসেন।