পূর্ববঙ্গের সুরের ধারা

পূর্ব পাকিস্তানের লোক–কৃষ্টি
রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, ১৯৬৮

ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ একটু আলাদা। এর জলজ আবহাওয়ায় কথায় সুর বসানো গান অহরহ খেলা করে। গ্রামে গ্রামে কবিয়াল, বাউল, লোকশিল্পী, যাত্রাভিনেতারা পাল্লা দিয়ে মাতেন গানের জলসায়। পল্লির মানুষ কথায় কথায় গ্রাম্য ছড়া আওড়ান, মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে ফেরি করেন গান। বিয়ে-সামাজিক উৎসবে বেয়াই-বেয়াইন বা রসিক কুটুম্বরা ঠাট্টাচ্ছলে ধাঁধার মারপ্যাঁচে একে অপরকে ঘায়েলের চেষ্টা চালান।

স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তান কিংবা পূর্ববঙ্গের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য আর আভিজাত্যকে উপস্থাপনের জন্যই ৫৫ বছর আগে প্রকাশিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের লোক-কৃষ্টি। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের লোকসাহিত্যচর্চায় এ বই এক আকরগ্রন্থ। এখন কালোত্তীর্ণও বটে।

বইটা প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালের জুন মাসে। প্রকাশক ছিলেন রেডিও পাকিস্তান ঢাকার পক্ষে হেমায়েত হোসেন। দাম দুই টাকা। মুদ্রাকরের পরিচিতিতে উল্লেখ আছে, ‘দি বেঙ্গল প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ৩/৪ পাটুয়াটুলী লেন, ঢাকা’। এটা মূলত সম্পাদিত বই। কিন্তু কে সম্পাদনা করেছেন সে-সম্পর্কিত কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। তবে বইয়ের শুরুতে রেডিও পাকিস্তান ঢাকার তৎকালীন আঞ্চলিক পরিচালক সৈয়দ জিল্লুর রহমানের ‘প্রসঙ্গ-কথা’ শিরোনামে একটা লেখা মুদ্রিত হয়েছে।

জিল্লুর তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, ১৯৬৭ সালের ৬ মে থেকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকার উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী লোককৃষ্টি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল লোককৃষ্টির বিভিন্ন ধারার সঙ্গে সর্বশ্রেণির বেতার-শ্রোতাদের পরিচিত করে তোলা। এ প্রচেষ্টা পূর্ব পাকিস্তানে সেটিই প্রথম। এতে খ্যাতনামা লোকসাহিত্যিকেরা মূল্যবান ও তত্ত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। বইটা সে আলোচনারই ফসল।

বইয়ে লেখা আছে ২২টি। মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮৪। লেখকেরা সে সময়ের পূর্ববঙ্গের লোককৃষ্টি, লোকসংস্কৃতি ও লোকগানের বিভিন্ন প্রাণবান ধারা নিয়ে লিখেছেন। এসেছে বাউল, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, সারি, জারি, ভাওয়াইয়া; বিচার, তরজা ও মরমি গানের প্রসঙ্গ। আছে পুঁথিসাহিত্য, লোকগাথা, মেয়েলি ছড়া আর ফকির শিতালং শাহকে নিয়েও সমৃদ্ধ রচনা। এসব লেখার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে আমাদের গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কী কারণে পূর্ববঙ্গকে বলা হতো সুরের দেশ, সেটিও ধরা পড়ে লেখাগুলোতে।

লেখক তালিকায় কে ছিলেন না? চোখ বোলালেই দেখা যায়, বড় বড় নাম—ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, মযহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, মুহম্মদ বরকতুল্লাহ, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, মতিন উদ্দীন আহমদ, জসীমউদ্‌দীন, আজিজুর রহমান, আসকার ইবনে শাইখ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজিবর রহমান খাঁ, আবুল কাসিম মোহাম্মদ আদম উদ্দীন, কাজী দীন মুহম্মদ, মোহাম্মদ আজরফ, আবদুল কাদির, মুহম্মদ আবদুল হাই, সিকান্‌দার আবু জাফর, সুলতান আহমদ ভূঁইয়া, বেগম সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম ও জোবেদা খানম।

কিছু লেখা একই বিষয়ের হলেও একেকটা লেখার ধরন একেক রকম। সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম ও জোবেদা খানম লিখেছেন পূর্ববঙ্গের মেয়েলি গান ও মেয়েলি ছড়া নিয়ে। জোবেদা লিখেছেন, ‘পল্লীর নরনারীগণ কুটিরে বসে যে সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করেছে, সে সুর আজ শুধু পল্লীবাসীদের মনেই নয়, শহরবাসীর মনেও আনন্দের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।’ সাড়ে পাঁচ দশক পেরিয়ে এ অনুভব এখনো কত প্রাসঙ্গিক!

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পল্লিবাংলায় ছড়িয়ে থাকা উপকথা, লোকগাথা, লোকগান, লোকছড়া, প্রবাদ, হেঁয়ালি, পুরাণকথা আর লোকসংস্কার নিয়ে লিখেছেন। অন্যদিকে মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন তাঁর লেখায় মরমিয়াবাদ থেকে বাউল-মুর্শিদি গানের জন্ম হয়েছে বলে মত দিয়েছেন।

আশরাফ সিদ্দিকী সুফি মতবাদ আর বাংলায় সুফি-দরবেশদের আগমন এবং তাঁদের উপলক্ষে রচিত মুর্শিদি গান নিয়ে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘লোকসংগীতগুলি সহজ লোকমনের সৃষ্টি বলেই তাতে এই সার্বজনীনতার ঢেউ জেগেছে। সকল সীমাবদ্ধতা, সকল সংকীর্ণতা এবং সকল বাধানিষেধের ঊর্ধ্বে উঠে সে সকল কালের সকল মানুষের বস্তু হয়ে উঠেছে।’

আমাদের গ্রামবাংলার নারীরা সংসারে হাড়ভাঙা খাটুনি আর শত বাধাবিপত্তি ও বিধিনিষেধের মধ্যেও সুরের রস নিজেদের মধ্যে সঞ্চার করেন, তা নিয়ে লিখেছেন সুফিয়া কামাল। ঢেঁকিতে ধান ভানতে-ভানতে গাওয়া মেয়েলি গান নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ছন্দের তালে তালে কঠোর শ্রমকেও সহজ-সুন্দর করে সখীরা মিলে হেসেখেলে জীবন নির্বাহ করছে, পল্লীগীতির এ মাধুর্য অপরিসীম।’

পল্লিগীতির মাধুর্যই আলাদা। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ এখানে মুখে-মুখে রচনা করেন গান, ছন্দ ও ছড়া। বারকয়েক কানে শুনেই শিল্পীরা মুখস্থ করে ফেলেন হাজারো পঙ্‌ক্তির পয়ার ছন্দের কিচ্ছা কিংবা পুঁথি। এক কণ্ঠ থেকে আরেক কণ্ঠে প্রবাহিত হয় গান–গীতিকা। অবসরে ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে গ্রামের মানুষ মেতে ওঠেন আনন্দযজ্ঞে, আস্ত রাত পার করেন গান শুনে। পূর্ব পাকিস্তানের লোক-কৃষ্টি বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় এসব চিত্রই সাজানো হয়েছে অক্ষরের পর অক্ষর বসিয়ে।