যেভাবে বড়দিন আসে পাথরঘাটায়
জিঙ্গেল বেল, জিঙ্গেল বেল, জিঙ্গেল অল দ্য ওয়ে—ঘণ্টা বাজাতে বাজাতেই আসবেন শ্বেতশুভ্র বৃদ্ধ, সান্তা ক্লজ। সামনেই বড়দিন। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব—যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন। সান্তা ক্লজের অপেক্ষায় চট্টগ্রামের পাথরঘাটার বাড়িতে বাড়িতে চলছে আয়োজন।
পাথরঘাটার মারিয়া ম্যানসনে ঢুকতেই পাওয়া গেল উৎসবের আমেজ। চারদিকে বর্ণিল আলোকছটা। নিচতলার সিঁড়ির সামনেই খড় দিয়ে বানানো হয়েছে গোয়ালঘরের প্রতিকৃতি—যিশুর জন্মদৃশ্য। পাশেই আলোকিত ক্রিসমাস ট্রি। দালানজুড়েই নানা রকম সাজসজ্জা। এই দালানের চারতলায় থাকেন স্যান্ড্রা সিলভিয়া স্যামসন, ডমিনিক স্যামসন দম্পতি ও তাদের দুই কন্যাসন্তান স্টেলা ও আর্ডেলা। তাদের সঙ্গেই কথা হলো বড়দিনের আয়োজন নিয়ে।
চট্টগ্রামে বড়দিনের উৎসবের ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই এসেছে পর্তুগিজদের থেকে। সেসব আচার প্রায় চার শ বছরের পুরোনো। তবে পরে বরিশাল থেকে আসা খ্রিষ্টানদের অনেক কিছু যোগ হয়েছে চট্টগ্রামের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে। বলছিলেন বরিশালের মেয়ে স্যান্ড্রা সিলভিয়া স্যামসন।
চট্টগ্রামের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বড়দিনের প্রধান খাবার বিভিন্ন ধরনের কেক। বিশেষ করে ফ্রুট কেক। বিভিন্ন রকম শুকনা ফল ও ফলের খোসা এবং মোরব্বা দিয়ে তৈরি হয় বড়দিনের কেক। রয়েছে চকলেট, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরিসহ নানা স্বাদের কেক। বড়দিনের তিন দিন আগেই চার রকমের কেক দেখা গেল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত ডমিনিক স্যামসনের বাড়িতে। কেকের সঙ্গে থাকে বিভিন্ন ধরনের বিস্কুট। সেগুলো কোনোটা ছোট্ট সান্তার আকারের, কোনোটা বা দেখতে মোজার মতো আবার কোনোটা তারার মতো।
চট্টগ্রামের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে কোল্ডমিট নামে গরুর মাংসের একটি বিশেষ পদের প্রচলন দেখা যায়। হাড়-চর্বি ছাড়া গরুর রানের মাংস লাগে কোল্ডমিট তৈরিতে। বেশ কয়েক দিন আগে থেকে সেটিকে বিভিন্ন রকম মসলা ও অন্যান্য উপাদান সহযোগে ম্যারিনেট করে ফ্রিজে রাখা হয়। পরে মাংসটিকে সেদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা ঠান্ডাই খাওয়া হয়। পর্তুগিজ খাবার ভিন্দালু আর কালকালও বেশ জনপ্রিয়। অনেকে আঙুর দিয়ে নিজেরাই বাড়িতে পানীয় তৈরি করেন বড়দিন উপলক্ষে।
বরিশালের মেয়ে হলেও স্যান্ড্রা স্যামসন বড় হয়েছেন ঢাকায়। তবে ছোটবেলা থেকে মাকে দেখেছেন বড়দিনের বিভিন্ন খাবার তৈরি করতে। স্যান্ড্রা জানালেন, বরিশালে বড়দিন মানেই দোদল ও ব্রিংকা পিঠা। বাড়ির উঠানে মাটির চুলা তৈরি করে চালের গুঁড়া, গুড় আরও নানা কিছু দিয়ে তৈরি হয় এই পিঠা। তবে প্রধান উপাদানটি হলো নারকেলের দুধ। যত বেশি নারকেলের দুধ দেওয়া যাবে পিঠাও তত মজা হবে বলে জানালেন স্যান্ড্রা।
বড়দিনে মিষ্টি খাবারের প্রাধান্য মূলত যিশুর জন্মোৎসবকে ঘিরে আনন্দে মিষ্টিমুখ করার জন্যই। সান্তা ক্লজের থেকেও শিশুরা উপহার পায় চকলেট, লজেন্স। পাথরঘাটার ক্যাথলিক চার্চে রাতব্যাপী চলে নাচ, গান, কয়ারসহ নানা আয়োজন। স্যামসন পরিবারের ছোট মেয়ে আর্ডেলা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বড়দিন ঘিরে বন্ধুদের নিয়ে নানা পরিকল্পনা তার। সবচেয়ে আগ্রহ নতুন জামা, জুতা ঘিরে। বড়দিনের আগে নতুন জামা যেন কেউ দেখে না ফেলে, তাই নিয়ে সাবধানে থাকতে হয়। মেয়ের এমন আনন্দ দেখে নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণা করলেন স্যান্ড্রাও।
আর্ডেলাদের বসার ঘরে প্রায় তিন ফুট উঁচু একটি ক্রিসমাস ট্রি সাজানো। ওপরে বেশ বড় একটি তারা, আলোকবাতি, বিভিন্ন আকারের রঙিন মোজা ঝুলছে। আর্ডেলা বলে, ‘শীতপ্রধান দেশে ফায়ার প্লেসের ওপর দড়িতে মোজা শুকাতে দেওয়া হতো। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে ফায়ার প্লেসের চিমনি দিয়েই সান্তা ক্লজ নেমে আসে। তারপর মোজার ভেতর চকলেট, সোনার কয়েন, লজেন্স রেখে যায়। তাই আমরাও ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে মোজার ব্যবহার করি।’
ডিসেম্বরের প্রথম রোববার থেকেই বড়দিনের আমেজ শুরু হয় পাথরঘাটায়। সবাই মিলে এক জায়গায় জড়ো হয়ে গানের মহড়া হয়। সেখানে গানের চেয়েও আনন্দটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। গান গেয়ে দল বেঁধে একে অপরের বাড়িতে বেড়াতে যান এলাকার সবাই। প্রতিবেশীরা সবাই সবাইকে উপহার দেন। বড়দিনে মূলত শিশুদের হাত দিয়ে এসব উপহার খোলা হয়। এ ছাড়া চার্চে রাতভর চলে প্রার্থনা, গান ও আনন্দ।
বড়দিনের আগে চারটি রোববার উপলক্ষে চারটি মোমবাতি জ্বালানো হয় বলে জানান স্যান্ড্রা। তিনি বলেন, ‘যিশুর বাণী মানুষকে যেমন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যায় তারই প্রতীক এই মোমবাতির আলো। আর ক্রিসমাস ট্রির ওপরে বড় তারাটা আমাদের পথনির্দেশক। ওই তারা যেভাবে তিন সাধুকে চিনিয়ে দিয়েছিল যিশুর জন্মস্থান, তেমনি আমাদেরও চিনিয়ে দেয় কল্যাণ ও ভালোবাসার পথ।’