সিরাজুল আলম খানের মৃত্যু
আড়ালে ছিলেন, নীরবেই চলে গেলেন
সিরাজুল আলম খানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে আজ সকাল ১০টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। তাঁকে সমাহিত করা হবে নোয়াখালীতে।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিরাজুল আলম খান আর নেই। গতকাল শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শোক জানিয়েছেন। রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও অনুসারীদের অনেকে গতকাল তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে যান। রাজনীতিকদের অনেকে বলেছেন, সিরাজুল আলম খান জনসমক্ষে আসতেন না এবং বক্তৃতা–বিবৃতিও দিতেন না। তিনি আড়ালে থেকেই তৎপরতা চালাতেন। এখন তিনি নীরবে চলে গেলেন।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘দাদাভাই’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তিনি উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ৭ মে থেকে তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে গত ২০ মে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ১ জুন ওই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয় এবং গতকাল শুক্রবার তাঁর মৃত্যু হয়।
সিরাজুল আলম খানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে আজ শনিবার সকাল ১০টায় ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। বেলা সাড়ে ১১টায় সিরাজুল আলম খানের মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হবে। এরপর তাঁর মরদেহ নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর মায়ের কবরে তাঁকে সমাহিত করা হবে।
সিরাজুল আলম খানের জন্ম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে, ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি। তাঁর বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন, গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক হন সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয় তাঁর উদ্যোগেই।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে যান জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক (নুর)।
রাজনৈতিক অঙ্গনে শোক
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা শোকবার্তায় বলেন, সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের একটি কালপর্বের অবসান হলো।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার শোকবার্তায় বলেন, ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার সংগ্রাম, ’৬৯–এর ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাঠে অগ্রণী ও অন্যতম প্রধান চিন্তক ও সংগঠক হিসেবে সিরাজুল আলম খানের ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তিতুল্য ভূমিকা ছিল। এর জন্য তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। এক শোকবার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল দেওয়া এক শোকবার্তায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনালগ্নের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে আমরা শোকাভিভূত। তিনি আমাদের সত্তার মাঝে অমর হয়ে থাকবেন।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে।
রাজনীতির আড়ালে থাকা ‘তাত্ত্বিক’
ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে এর নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছাত্র–তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন সিরাজুল আলম খানসহ ওই ছাত্রনেতারা।
কিন্তু ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। তখন ছাত্রলীগ ভেঙে ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদের প্রতিষ্ঠা হয়।
সিরাজুল আলম খান কখনো দলের নেতৃত্বে ও জনসমক্ষে আসতেন না। তিনি জাসদ নেতাদের আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন। সে জন্য তিনি জাসদ নেতাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ এবং রাজনীতির ‘রহস্যপুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।
দীর্ঘদিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। চিরকুমার সিরাজুল আলম খান কয়েক বছর ধরে ঢাকার কলাবাগানে ভাইদের সঙ্গে থাকতেন বলে তাঁর পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদের বই প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘সিরাজুল আলম খান তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা বলেছিলেন। সেটি হলো, ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।’
শেষ ইচ্ছা অনুযায়ীই সিরাজুল আলম খানকে তাঁর গ্রামে মায়ের কবরে তাঁকে সমাহিত করার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে তাঁর স্বজনদের পক্ষ থেকে।