‘র‍্যাবের অভিযান শুরুর পর তারা আমাকে মাটিতে ফেলে মারধর শুরু করে’

কক্সবাজারের টেকনাফে অপহরণকারীদের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন শ্রমিক সাইফুল ইসলাম। গত মঙ্গলবার তোলাপ্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফের জাদিমোরার বাসিন্দা জুহুর আলমের ছেলে সাইফুল ইসলাম এখনো স্বাভাবিক হননি। গত সোমবার জাদিমোড়া পাহাড়ে বন বিভাগের কাজ করার সময় অপহরণের শিকার হন তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরুর পর গত মঙ্গলবার বিকেলে ১৯ জন শ্রমিকের সঙ্গে তিনি ছাড়া পান।

কী হয়েছিল সেদিন—জানতে চাইলে সাইফুল বলেন, ‘পাহাড়ে কাজ করার ফাঁকে শ্রমিকেরা তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময় অস্ত্রধারীরা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তখন আমাদের হাতে লম্বা দা ছিল। অস্ত্র তাক করে দা কেড়ে নেয় তারা। পরে রশি দিয়ে বেঁধে রোহিঙ্গা শিবিরের পশ্চিমে গহিন পাহাড়ে নিয়ে যায়। হাতে থাকা মোবাইল ফোন থেকে পরিবারের কাছে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা আদায় করার জন্য বেদম মারধর করা হয় আমাদের। সারা রাত পানি ছাড়া আর কিছু খেতে দেওয়া হয়নি।’

একটু দম নিয়ে সাইফুল বলতে থাকেন, ‘র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু করলে সন্ত্রাসীরা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, শ্রমিকদের মাঝি আমার বাবা জুহুর আলম। সন্ত্রাসীরা র‌্যাবের অভিযানের জন্য বাবাকে দায়ী করতে থাকেন। এ সময় আমাকে হত্যা করার ঘোষণা দেয় তারা। মাটিতে ফেলে মারধরও করা হয়। একপর্যায়ে পাহাড় থেকে একটি পিস্তল ও একটি ব্যাগ নিয়ে দুজন সন্ত্রাসী নেমে যায় লোকালয়ের দিকে। র‌্যাব ও পুলিশ কখন, কোথায় যাচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্তে খবর পাচ্ছিল তারা। তাদের লোকজন রয়েছে সব জায়গায়। বিপুলসংখ্যক র‌্যাব ও পুলিশের অভিযান শুরু করে বলে তারা বলাবলি করছিল। পাশাপাশি ড্রোনও ব্যবহার হয়েছে। এ কারণে সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ার ভয়ে বিকেলে আমাদের ছেড়ে দিয়ে গহিন পাহাড়ের দিকে চলে যায়। পরে আমরা পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় র‌্যাব ও পুলিশ তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়।’

কক্সবাজারের টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীর হাতে অপহৃত বন বিভাগের ১৯ শ্রমিককে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা এলাকার রঙ্গিখালী গ্রামের পশ্চিমের গহিন পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গত সোমবার সকালে বনে কাজ করতে গেলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এসব শ্রমিককে অপহরণ করা হয়। পরে সন্ত্রাসীরা অপহৃত ব্যক্তিদের পরিবারের মুঠোফোনের মাধ্যমে জনপ্রতি এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। দাবি করা টাকা দিতে না পারলে লাশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হুমকিও দেয় অপহরণকারীরা। পরে স্থানীয় জনতা, বন বিভাগের কর্মী, পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন সদস্যরা তাঁদেরকে উদ্ধারের জন্য অভিযান চালান। বনের ভেতরের অভিযানের পাশাপাশি ড্রোন দিয়ে অভিযান পরিচালনায় করায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী অপহৃত ব্যক্তিদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সবার সহযোগিতায় অপহৃতদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে আমরা অভিযান শুরু করি। মূলত ড্রোন দিয়ে অভিযানের ফলে অপহরণকারীরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যায়। যার কারণে আমরা অপহৃতদের উদ্ধারে সক্ষম হয়েছি। বাহারছড়ায় অপহরণের শিকার আরও ৯ জনকেও উদ্ধারে অভিযান চলছে পাহাড়ে।’

অপহৃতদের উদ্ধারে ড্রোনের ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
ছবি: সংগৃহীত

এদিকে টেকনাফের বনে কাজ করার সময় ১৯ জন বন বিভাগের শ্রমিককে অপহরণের ঘটনায় বন বিভাগের টেকনাফ রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে অজ্ঞাতনামা ২৫-৩০ জনের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলার বাদী রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, অপহৃত ব্যক্তিরা কাউকে চিনতে পারেননি। দেখলে শনাক্ত করতে পারবেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন অপহৃত শ্রমিকেরা। সেভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৮১ জনকে অপহরণ করে নিয়ে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।