আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করতে হবে এক মাসে
গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আগামী এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই ধরনের অভিযোগে ওবায়দুল কাদেরসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী–সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালী ৪৫ জনের ক্ষেত্রে পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকে এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গতকাল সোমবার এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গত জুলাই-আগস্টে গণ–অভ্যুত্থানের সময় দেশে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তের জন্য দুই মাস সময় চান। তবে ট্রাইব্যুনাল এক মাস সময় মঞ্জুর করে আগামী ১৭ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার–সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনও সেদিন জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সারা দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অসংখ্য অভিযোগ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় ও তদন্ত সংস্থার কাছে জমা হয়। এর মধ্যে একটি মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং আরেক মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের মধ্যে ৯ জন সাবেক মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৭ অক্টোবর থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। আর গতকাল প্রথমবারের মতো শুনানি হলো ট্রাইব্যুনালে।
শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, তদন্ত সংস্থার কাছ থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে করা পৃথক মামলার বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। শেখ হাসিনা এখন ভারতে আছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিবেদন দিয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ভারতের সঙ্গে থাকা চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার চেষ্টা করছে সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সবচেয়ে বড় দায় শেখ হাসিনার বলেও অভিযোগ করেন চিফ প্রসিকিউটর।
ট্রাইব্যুনালে সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জন
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এই প্রথম আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। একসঙ্গে ১৩ জন আসামি গতকাল ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। আরও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম।
এর আগে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া এই ১৩ জনকে গতকাল ট্রাইব্যুনালের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে শুনানি শেষে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। পাশাপাশি এই মামলার বাকি আসামিদেরও (গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকা) আগামী ১৭ ডিসেম্বর হাজির করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
শুনানি শুরু হয় বেলা ১১টায়। আসামিদের বিভিন্ন কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয় সকাল ১০টায়। শুনানি শুরু হলে আদালত সবাইকে বসতে অনুমতি দেন।
আসামিদের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালকে বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ড সংঘটনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁরা। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গেও তাঁরা জড়িত ছিলেন। ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র দায়ে তাঁরা অভিযুক্ত। অপরাধ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সেটি করেননি। জুলাই–আগস্টে সংঘটিত সব ধরনের অপরাধের দায় তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আছে।
চিফ প্রসিকিউটর যখন আসামিদের সম্পর্কে অভিযোগ তুলে ধরছিলেন, তখন কাঠগড়ায় নিশ্চুপ ছিলেন তাঁরা। শেখ হাসিনাসহ তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের গণহত্যায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শুধু এক ব্যক্তিকে (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় রাখতে গণহত্যা চালাতে তাঁরা দ্বিধা করেননি। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংসের মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করেছে। বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নিরস্ত্র নেতা–কর্মীদের ওপর পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিচারবহির্ভূত গুম–খুনের ঘটনা ঘটেছে। র্যাবকে ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মানুষের বাক্স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। রাজাকার শব্দ ব্যবহার করে ভিন্নমত ও বিরোধী দলের ওপর দমন–পীড়ন চালানো হয়েছিল।
ট্রাইব্যুনালে গতকাল সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাককেও হাজির করার কথা ছিল। তবে অন্য একটি মামলায় (ট্রাইব্যুনালের নয়) রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় নেওয়া হয়। যে কারণে সেখান থেকে তাঁকে আনা সম্ভব হয়নি বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ আরও ভালো বলতে পারবে। এ সময় কারা কর্তৃপক্ষের কেউ আছেন কি না, তা জানতে চান ট্রাইব্যুনাল।
তবে কারা কর্তৃপক্ষের কেউ তখন ট্রাইব্যুনালে ছিলেন কি না, তা বোঝা যায়নি। কারণ, কেউ কথা বলেননি। পরে শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন, যোগাযোগসংক্রান্ত ত্রুটির কারণে সাবেক কৃষিমন্ত্রীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা সম্ভব হয়নি।
এর আগে শুনানির সময় চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সামনে আসামিদের বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আনা হয়েছে, তা বলতে থাকেন। প্রত্যেক আসামি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরার এক পর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, নিঝুম মজুমদার (আইনজীবী ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট), তিনি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণহত্যার পক্ষে উসকানি দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
শুনানিতে যা হলো
শুনানিতে পাঁচজন আসামির পক্ষের আইনজীবী হিসেবে উপস্থিত হন এহসানুল হক সমাজী। শুনানির শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, এহসানুল হক সমাজীকে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই তিনি আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে থাকলে তা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ (স্বার্থের সংঘাত) হবে। তাঁকে আসামিপক্ষের হয়ে শুনানি না করতে অনুরোধ জানান চিফ প্রসিকিউটর।
তখন এহসানুল হক সমাজী বলেন, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি পাননি। তাই বিষয়টি (গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব) নিয়ে কিছু বলতে পারছেন না। এ ছাড়া যে দায়িত্ব দেওয়ার কথা চিফ প্রসিকিউটর উল্লেখ করেছেন, সেই দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করবেন কি না, তা–ও ভাবার বিষয়।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, কোন আসামির পক্ষে তিনি এসেছেন। জবাবে এহসানুল হক সমাজী পাঁচজনের নাম বলেন। তাঁরা হলেন আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, ফারুক খান, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও জুনাইদ আহ্মেদ। এরপর তিনি আসামিদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করা থেকে বিরত থাকেন।
পরে শুনানি শেষে এহসানুল হক সমাজী সাংবাদিকদের বলেন, চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর ‘আদালত ও সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে’ আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে বক্তব্যদান থেকে বিরত ছিলেন।
শুনানিতে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও মুহাম্মদ ফারুক খানের আইনজীবী হিসেবে ছিলেন আজিজুর রহমানসহ তিনজন আইনজীবী। তাঁরা ট্রাইব্যুনালের কাছে ওই দুই আসামির অভিযোগনামা পাওয়ার আরজি করেন। পরে সেই আবেদন মঞ্জুর করে অভিযোগনামা দিতে নির্দেশনা দেন ট্রাইব্যুনাল।
এ ছাড়া আসামিদের সঙ্গে তাঁদের স্বজন ও আইনজীবীরা যেন কথা বলতে পারেন, ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানান আজিজুর রহমান। তাঁর সেই আবেদনও মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।
শুনানি শেষে আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের ভেতরে আসামিদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনাল থেকে আসামিদের আবার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।