রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি

পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সেমিনারে বক্তব্য দেন। ঢাকা, ২৩ নভেম্বরছবি: প্রথম আলো

রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারজুড়ে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা সংকটে জটিলতা বেড়েছে। তাই রোহিঙ্গা সংকটের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক উত্তরণের পর্ব থেকে জাতীয় ঐকমত্যের অভাবে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি।

শনিবার রোহিঙ্গা সংকটবিষয়ক এক জাতীয় সংলাপে বিশেষজ্ঞরা এমন মন্তব্য করেছেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি) ‘বাংলাদেশের রোহিঙ্গা নীতির স্বার্থে জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়াস’ শীর্ষক ওই সংলাপের আয়োজন করে।

দিনব্যাপী আলোচনায় উদ্বোধনী ও সমাপনী অধিবেশন ছাড়াও দুটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্যের অভাব যে কত বিধ্বংসী ছিল, এটা আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাঁরা কাজ করি, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। অনেক বিষয়ে যেটাতে আমরা বেশি সুফল পেতে পারতাম, সেখানে জাতীয় ঐকমত্য না থাকায় কম অর্জনটা আমাদের মেনে নিতে হয়েছে।’

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘...অন্তর্বর্তী সরকার তো অল্প কিছুদিন আছে। এরপর তো নির্বাচিত সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকবে। আপনারা একটা কিছু গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। এটা (জাতীয় ঐকমত্য) করতে পারলে আমাদের শক্তি অনেক গুণ বেড়ে যাবে।...আশা করি, আগামী দিনগুলোতে রোহিঙ্গাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একধরনের জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হবে।’

তৌহিদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা নিয়ে বিগত সরকারের চুক্তি অকার্যকর ছিল। একটা দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভুলে যেতে দেওয়া যাবে না যে রোহিঙ্গা এখনো আছে। বাংলাদেশ এই সমস্যা একা সমাধান করতে পারবে না। এখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শক্তভাবে পাশে পেতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে একটা অবস্থান নিয়েছে। তাতে তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি কর্মসংস্থানে যুক্ত করার বিষয়টি রয়েছে। তিনি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দেন।
বিএনপির এই নেতা বলেন, বহুপক্ষীয় উপায়ে আন্তর্জাতিক জনমত ও সমর্থন জোরদার করা এবং অভ্যন্তরীণ দর-কষাকষি বাড়ানোর লক্ষ্যে সামরিক শক্তি, সীমান্তের শক্তি, বার্তার শক্তি থাকতে হবে। সঙ্গে জাতীয় ঐক্য রাখতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে সব অংশীজনকে নিয়ে জোরালো প্রয়াস চালাতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা এবং অগ্রাধিকারবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান সরকার আগামী বছরের শুরুতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিসংঘের একটি সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই মনোযোগ ফেরানোর চেষ্টা করছে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হচ্ছে। আন্তসীমান্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতির প্রতিদিন অবনতি ঘটছে। রাখাইনের গৃহযুদ্ধে আরাকান আর্মির পক্ষে কুকি চীন আর্মির সদস্যদের অংশগ্রহণ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান এলাকার জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা ইস্যু সৃষ্টি করবে। আমাদের এই বিষয়টির সুরাহা করতে হবে।’  

এসআইপিজির পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হকের সঞ্চালনায় সংলাপে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন এসআইপিজির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মোহাম্মদ সুফিউর রহমান। বিভিন্ন অধিবেশনে আলোচনায় অংশ নেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি সুম্বল রিজভী, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মিশনপ্রধান লেনস বানো, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ নাজিমুদ্দীন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান মাহমুদ শামসুদ্দীন, শরণার্থী ত্রাণ এবং প্রত্যাবাসনবিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক বুলবুল আশরাফ সিদ্দিকী ও সহকারী অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহাব।