ডব্লিউএফপির জরিপ: খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় দেশের ২৪% মানুষ
দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া এবং এসবের কারণে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যাওয়া খাদ্য পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম কারণ বলে ডব্লিউএফপি মনে করে।
দেশের প্রতি চারজনের একজন খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় আছেন। আর হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৪৬ শতাংশ আছেন এ অবস্থায়। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) থেকে চলতি মাসে প্রকাশ করা এক জরিপ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
‘বাংলাদেশ ফুড সিকিউরিটি মনিটরিং রিপোর্ট: মে-আগস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে ৩ অক্টোবর। দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া এবং এ কারণে মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বৃদ্ধি খাদ্য পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় গ্রীষ্মকালে কম বৃষ্টি হয়েছে ও টানা তাপপ্রবাহ ছিল। বিশেষ করে রাজশাহী বিভাগে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ছিল বেশি। গত আগস্টে চট্টগ্রাম ও সিলেট হঠাৎ বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিধসের ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরও একই ধরনের আবহাওয়ার কারণে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছিল।
দেশে যে অভাবী মানুষ বেড়েছে, তা রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যায়। তাই একটি অংশের মানুষ যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন, তা সবার আগে স্বীকার করে নিতে হবে।সাজ্জাদ জহির, নির্বাহী পরিচালক, ইআরজি
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ‘বাংলাদেশ মার্কেট মনিটর: মে-জুলাই’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডব্লিউএফপি। সেখানে সংস্থাটি প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং রিজার্ভ-সংকটের (বৈদেশিক মুদ্রা) কারণে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে উল্লেখ করে। একই সঙ্গে সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল ও সবজির মতো খাদ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে বলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। গত আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ শতাংশ কমেছে এবং টাকার মান এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এ ছাড়া ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রকাশ করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা ও ব্যয় জরিপে দেশে দারিদ্র্য ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ বলা হয়েছিল। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও দারিদ্র্যের হার কমেছে বলে এ জরিপে উঠে আসে।
দেশের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর অবস্থা বুঝতে মিরপুরের পূর্ব কাজীপাড়ার বাসিন্দা মিনারা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। অন্যের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন তিনি। পরিবারের অন্য তিনজনের দুজন দিনমজুরির কাজ করেন। সব মিলিয়ে পরিবারের আয় মাসে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। পরিবারে তিন বেলার খাবার জোগাতে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, চালের দাম কিছুটা কমেছে, কিন্তু সবজি-ডিমের খরচ তো বেড়েছে।
এ পটভূমিতে আজ সোমবার বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘পানিই জীবন, পানিই খাদ্য। কাউকে পেছনে ফেলে এগোনো যাবে না।’
ডব্লিউএফপির প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি গুদামে ১৫ লাখ টনের ওপরে চাল ও দেড় লাখ টনের মতো গম আছে। আর স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বিস্তৃত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় চাল ও গম বিতরণ করছে সরকার। খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত কর্মসূচির বাইরে সরকার টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি দরিদ্র মানুষের জন্য চাল, গমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করছে। ফলে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি যে ২৪ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় আছেন বলে তথ্য দিচ্ছে, তা সঠিক মনে হয় না।
খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার চিত্র ও কারণ
ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেশের ২৪ শতাংশ মানুষ এবং হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে ৪৬ শতাংশ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছেন। তবে মধ্য আয়ের পরিবারগুলোর ৯ শতাংশ এবং উচ্চ আয়ের পরিবারের ৩ শতাংশ এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিসংক্রান্ত ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সোয়া পাঁচ কোটির বেশি মানুষ খাদ্যে তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছেন। এর মধ্যে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন ১ কোটি ৮৭ লাখ মানুষ।
ডব্লিউএফপির জরিপে ৭১ শতাংশ পরিবার খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে সর্বোচ্চ উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতি ১০ জনের ৭ জন জীবনযাত্রার মান কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। যাঁদের বড় অংশ আগের চেয়ে খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন, ঋণ করছেন এবং উৎপাদনশীল সম্পদ বিক্রি করছেন ও বাকিতে খাবার কিনছেন।
খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণ হিসেবে সংস্থাটি প্রতিবেদনে বলেছে, মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে ও ধারাবাহিক দারিদ্র্য (ক্রনিক পোভার্টি) পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার চিত্র উঠে আসে।
বাড়ছে ঋণগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা
খাবার কিনতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বাকিতে খাবার কিনতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এ ধরনের মানুষের সংখ্যা চলতি বছরের মে মাসে ছিল ৩২ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাকিতে খাবার কিনতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা সিলেটে ৫৩ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ৫৮ শতাংশ। এসব মানুষ সরকারি ও বেসরকারিভাবে খুব বেশি সহায়তাও পাননি। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ আগস্ট মাসে সহায়তা পেয়েছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি ১০ পরিবারের ৩টি পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। আর দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় এ হার জনসংখ্যার অর্ধেক। দেশের ৭৪ শতাংশ মানুষ কম পরিমাণে ও সস্তা খাবার কিনছেন। সামগ্রিকভাবে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমেছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যে অভাবী মানুষ বেড়েছে, তা রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যায়। তাই একটি অংশের মানুষ যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন, তা সবার আগে স্বীকার করে নিতে হবে। ‘দেশে বিপুল পরিমাণে খাদ্য মজুত আছে, উৎপাদন ভালো হয়েছে’—এসব কথা বললেই দরিদ্র মানুষের পেটে খাবার যাওয়া নিশ্চিত হয় না। এ জন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে।
ডব্লিউএফপি ২০২২ সালের জুলাই থেকে খাদ্যনিরাপত্তা ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ করছে। সারা দেশ থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নেওয়া ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপরে এ জরিপ করা হচ্ছে। শুরুতে অতিমারি করোনার প্রভাব ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং ব্যয় বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে আসে। সর্বশেষ জরিপে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার চিত্র উঠে এল।