রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার করে পাঠাগার, জাদুঘর নির্মাণের দাবি
সাইকেলে চড়ে বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন হবিগঞ্জের রামনাথ বিশ্বাস। আজ মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) এই পর্যটকের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় একটি সেমিনারের। সেমিনারে রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার করে সেখানে ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের বিশেষায়িত পাঠাগার, বাইসাইকেল জাদুঘর এবং অতিথিশালা নির্মাণের দাবি জানিয়েছে ‘ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি’। পাশাপাশি ১৩ জানুয়ারি রামনাথের জন্মদিনকে ‘রামনাথ দিবস’ ঘোষণারও দাবি জানানো হয়েছে।
বিকেলে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘রামনাথ বিশ্বাস: বিশ্বজোড়া পাঠশালা তাঁর’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক আহসানুল কবীর। লিখিত ওই প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘সর্বকালের সেরা ভূপর্যটকদের তালিকা করলে রামনাথ বিশ্বাসের নাম লিখতেই হবে। বাঙালি জাতি ঘরকুনো, তারা ভ্রমণ করতে জানে না—এ অপবাদ ঘুচিয়েছেন রামনাথ।’ রামনাথ বিশ্বাস সাইকেলে ৫৩ হাজার, পায়ে হেঁটে ৭ হাজার, রেলগাড়িতে ২ হাজার এবং জাহাজে ২৫ হাজার মাইল ভ্রমণ করেছিলেন জানিয়ে এই গবেষক লিখেছেন, ‘রামনাথকে পাঠ করতে হবে। তাঁর জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
রামনাথ বিশ্বাসকে বিশ্বপাঠশালার একনিষ্ঠ ছাত্র উল্লেখ করে আহসানুল কবীর বলেন, ‘তিনি অর্জন করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, দেখেছেন ভিন্ন ভিন্ন সমাজব্যবস্থা, পরিচিত হয়েছেন বিপরীত সব রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে। ভিনদেশি ইবনে বতুতাকে আমরা চিনি, স্বদেশি রামনাথকে জানি না। ভিনদেশি সিরাজউদ্দৌলার জন্য অশ্রুপাত করি, ভূমিপুত্র সমশের গাজীকে বলি ডাকাত। রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায় সম্পর্কে জানি, অথচ এই মাটির সন্তান ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের সাধনার কথা বলি না। হাজি মুহম্মদ মহসীনের দানশীলতার কথা বলি, মহেশ ভট্টাচার্যের নামও উচ্চারণ করি না। এই দায় কার? রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থা, আমরা সবাই কমবেশি এ জন্য দায়ী।’
আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, ‘স্কুলে পড়াকালীন প্রথম রামনাথের লেখা বই পড়েছিলাম। বানিয়াচংয়ে রামনাথের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। মৌলভীবাজারের আরেক কীর্তিমান নীলা রায়ের স্মৃতিও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না, সেটি রামনাথের ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও স্পষ্ট হলো। মৌলভীবাজারে নীলা রায়ের বসতভিটা, বানিয়াচংয়ে রামনাথের বসতভিটা এবং মানিকগঞ্জে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রী প্রমীলার বাড়িও পুনরুদ্ধার করা হোক।’
রামনাথকে উপনিবেশবাদবিরোধী উল্লেখ করে মফিদুল হক বলেন, ‘রামনাথ আফ্রিকায় গিয়ে একেবারে মানুষের ভেতর থেকে জীবনকে দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন উপনিবেশবাদবিরোধী। তিনি চেয়েছিলেন কালো মানুষেরা জেগে উঠুক।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে অনেক ভ্রমণকাহিনি লেখককে আমরা চিনি। কিন্তু রামনাথ বিশ্বাস যেখানে আলাদা, সেটি হলো তিনি ছিলেন একেবারেই নিপাট পর্যটক। যাঁর ছিল না আড়ম্বরপূর্ণ উচ্চশিক্ষা, ভ্রমণে খুব বেশি অর্থও তিনি সঙ্গে নিতেন না। তাঁর ছিল অসম্ভব সাহস আর অসীম কৌতূহল।’
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘রামনাথ বিশ্বাসের ভ্রমণকাহিনি লেখার অসাধারণ হাত আমি আবিষ্কার করি তাঁর “তরুণ তুর্কী” বইটি পড়ে। তত দিনে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে কামাল আতাতুর্ক সেখানে বিপ্লব করে ফেলেছেন। রামনাথ বিশ্বাসের ওই ভ্রমণকাহিনি পড়ে আমার মনে হয়েছে, আমি যেন এক নতুন তুরস্ককে দেখছি।’
রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা আলবদর পরিবারের দখলে রয়েছে এবং এটি লজ্জাজনক উল্লেখ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে এটা খুবই লজ্জাজনক ঘটনা। এই বসতভিটার পুরোটুকুই পুনরুদ্ধার করার আন্দোলনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পাশে থাকবে।’
আলোচক সাবেক অতিরিক্ত সচিব জালাল আহমেদ বলেন, ‘বানিয়াচংকে কেন্দ্র করে পর্যটন পরিকল্পনা করার প্রতিশ্রুতি আছে সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। রামনাথের নামে সেখানে মিউজিয়াম করার উদ্যোগ নিতে পারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।’
ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বলের সভাপতিত্বে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহেদ কায়েস। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সাংবাদিক দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু ও ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী।
রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা উদ্ধারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও বানিয়াচংয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তৎপরতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে রামনাথ বিশ্বাসের বেদখল বসতভিটার ১ একর ১৬ শতাংশ ভূমি উদ্ধারের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ। অকৃতদার রামনাথের কোনো স্বজন নেই। তিনি বাংলাদেশের গৌরব। তাই তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।’
রামনাথ বিশ্বাসের প্রয়াণ দিবস স্মরণে একক বইমেলারও আয়োজন করে জলপড়ে ডটকম। রামনাথ বিশ্বাসকে নিয়ে নিজের লেখা গান গেয়ে শোনান বাউল বশিরউদ্দিন সরকার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন রুমা মোদক।
ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির ইচ্ছা, ১৩ জানুয়ারি সারা দেশের সাইক্লিস্ট গ্রুপগুলো রামনাথের স্মরণে তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে বাইসাইকেল শোভাযাত্রা করুক। সেই সঙ্গে সরকারের কাছে তাদের আহ্বান, প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকে যেন রামনাথের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বর্তমান হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণপাড়ায় ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি রামনাথ বিশ্বাসের জন্ম। বাবা বিরজানাথ বিশ্বাস আর মা গুণময়ী দেবীর দুই সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর কলকাতায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্বজয়ী ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস।