ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ মানুষ, ফেনীতে বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করছে মানুষ

ফেনীর ফাজিলপুর রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যা কবলিত এলাকার মানুষজনফাইল ছবি: জুয়েল শীল

বুকসমান উঁচু বন্যার ঘোলা পানির ভেতর দিয়ে শতাধিক মানুষ ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছে। সঙ্গে থাকা অল্প কিছু জিনিসপত্র ভিজে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে তারা সেগুলো মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে বাংলাদেশের দক্ষিণ–পূর্বের শহর ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনের সাংবাদিকদের একটি দল সেখানে গিয়ে এ দৃশ্য দেখতে পান।

গত বুধবার রাত থেকে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ফেনীসহ বাংলাদেশের ১১–১২টি জেলা। প্রায় ১৫ লাখ মানুষের শহর ফেনীর বেশির ভাগই এখন বন্যার পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

চারদিন পর মেয়ে সাদিয়া আক্তারের দেখা পেয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা সাইফুল ইসলাম। ২৫ আগস্ট, সকাল ১১টায় ফেনী লালপোল এলাকায়
ছবি: জুয়েল শীল

এ বন্যাকে আকস্মিক বলা হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ুতে যে পরিবর্তন এসেছে, তাতে প্রকৃতি বিরূপভাবাপন্ন আচরণ করছে।

যদিও আকস্মিক এ বন্যার জন্য স্থানীয় মানুষেরা প্রতিবেশী দেশ ভারতের কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন।

সিএনএন ফেনীর এক ডজনের বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। ভারত সীমান্ত থেকে ফেনীর দূরত্ব মাত্র কয়েক মাইল। ফেনীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভারত সরকার কোনো ধরনের সতর্কবার্তা না দিয়েই ফেনীর পাশের রাজ্য ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে।

সিএনএনের প্রতিনিধিরা বন্যাদুর্গতদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কেউ কেউ চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমরা ভারতকে ঘৃণা করি। এটা ভারতের পানি।’

আইটিকর্মী ২৯ বছরের শরিফুল ইসলাম বন্যাদুর্গতদের সহায়তা করতে রাজধানী ঢাকা থেকে ফেনীতে গেছেন। তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘তারা কোনো খবর না দিয়েই গেট খুলে দিয়েছে। ভারত পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। সর্বশেষ সরকারকে উৎখাত করার প্রতিশোধ নিচ্ছে তারা।’

ভারত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, বৃষ্টির পানি এখানে ভূমিকা রেখেছে। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা এটা স্বীকার করেছেন, বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ও যোগাযোগব্যবস্থা ধসে পড়ায় ভাটিতে থাকা প্রতিবেশীদের জন্য সাধারণত যে সতর্কতা জারি করা হয়, তাঁরা এবার তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

বন্যার পানিতে খামার থেকে ভেসে গেছে মুরগি। দুই–একটি যা উদ্ধার করতে পেরেছেন তা নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন এই ব্যক্তি। ২৪ আগস্ট, দুপুরে ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে
ছবি: জুয়েল শীল

‘জানি না তাঁরা বেঁচে আছে কি না’

ফেনীর বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণে স্বেচ্ছায় কাজ করছে, এমন দুটি দলের সঙ্গে বন্যাদুর্গত এলাকা ঘুরেছেন সিএনএন প্রতিনিধিরা।

সেখানে এখন চলাচলের একমাত্র উপায় নৌকা। প্রধান সব সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে, চলতে পারছে না কোনো যানবাহন।

বিদ্যুতের অভাবে উদ্ধার অভিযানের গতি ধীর। প্রায় পুরো নগরী বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় সমন্বয় ও সহায়তা করছে। গত কয়েক দিনে সারা দেশ থেকে অনেক মানুষ স্বেচ্ছায় বন্যাদুর্গতের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে।

স্বেচ্ছাসেবীদের কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করতে বন্যাদুর্গত এলাকায় এসেছেন। এমনই একজন ৩৫ বছরের আবদুস সালাম। রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা এই শিক্ষক বলেন, ফেনীর কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত একটি গ্রামে তাঁর দুই বোন, ভাই এবং তাঁদের সন্তানেরাসহ পরিবারের ১২ সদস্য আটকা পড়ে আছেন।

সিএনএনকে আবদুস সালাম বলেন, ‘তাঁরা এমনকি বেঁচে আছে কি না, সেটাও আমি জানি না। আমার বারবার কান্না পাচ্ছে।’

আবদুস সালাম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত বন্যায় ২৩ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম। যে সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কাও করা হয়েছে। ভারতে এবার বন্যায় অন্তত ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যে ৬৪ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।

সাধারণ বন্যা নয়

বাংলাদেশে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। তাঁদের অভিযোগ, এ দুর্ভোগের কারণ ভারত।

কেউ কেউ এর মধ্যে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে বলেও মনে করেন।

তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঁধের গেট খুলে গেছে’।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রেস সচিব হাইকমিশনারের উদ্ধৃতি দিয়ে এমন তথ্য জানিয়েছেন।

ছাত্রদের নেতৃত্বে টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা বিক্ষোভের জেরে ৫ আগস্ট বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান তিনি। তিনি এখনো ভারতের আশ্রয়েই আছেন।

বন্যার স্রোতে পড়ে হাত ভাঙে ছয় বছর বয়সী তাবাসুনের। মা-মামা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ফাজিলপুর, ফেনী, ২৪ আগস্ট
ছবি: জুয়েল শীল

চারদিকে ভয়-আতঙ্ক

পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করতে ঢাকা থেকে ফেনীতে এসেছেন ২৪ বছরের তরুণ ইয়াসিন আরাফাত। বন্যার পানিতে তাঁর বাবা, মা, দাদি ও ছোট ভাই আটকা পড়েছেন। এত দূর এসেও তিনি এখন তাঁর পরিবারের কাছে যেতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। কারণ, কোনো নৌকা জোগাড় করতে পারছি না।’

ইয়াসিন বলেন, তিনি শুনেছেন, তাঁর গ্রামের ৩৫টি পরিবার একটি বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের মধ্যে দুজন অন্তঃসত্ত্বা নারীও রয়েছেন। ফেনী শহর থেকে তাঁদের গ্রামে যেতে নৌকায় তিন ঘণ্টা লাগবে।

‘তাদের কাছে পানি নেই, খাবার নেই। তারা খুবই আতঙ্কে দিন পার করছে। গত ৪৮ ঘণ্টা আমি তাদের কোনো খবর পর্যন্ত জানতে পাইনি।’

৩৬ বছরের পেয়ারা আক্তার ফেনীর কাছের একটি গ্রামে বসবাস করা তাঁর বোন ও বোনের এক মাস বয়সী সন্তানকে উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। এই নারী বলেন, ‘বাচ্চাটি অসুস্থ, চিকিৎসা দরকার। আমার ভয় হচ্ছে, সে এই দুর্ভোগের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারবে কি না।’

পেয়ারা আক্তার জানতে পেরেছিলেন, তাঁর বোন স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। সেই বিশ্বাস থেকে তিনি বোন ও তাঁর সন্তানকে খুঁজতে এসেছিলেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর ব্যর্থ হয়ে তিনি নিজ বাড়ির পথ ধরেন। তাঁর আশা, তিনি বোনকে কোনো না কোনোভাবে খুঁজে পাবেন।

সড়কটি পাঁচ দিন ধরে জলমগ্ন। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরসমান। আশপাশের বিপণিবিতান, হাসপাতাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিচতলা পানিতে ডুবে আছে। দুর্ভোগে মানুষ। ২৫ আগস্ট,বেলা দুইটায় ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কে
ছবি: জুয়েল শীল

কাতারে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করা ফেনীর এক বাসিন্দা বন্যার খবর জানতে পেরে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে দেশে ফিরে আসেন।

তিনি একটি নৌকা সংগ্রহ করে গ্রামে তাঁর ৫৫ বছর বয়সী মাকে উদ্ধার করার জন্য যেতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁদের গ্রাম প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় এবং যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় যেতে পারছেন না। তিনি একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অন্য স্বজনদের সঙ্গে অবস্থান করছেন।

এক বয়স্ক দম্পতি, একটি শিশু ও শিশুটির মা অন্যদের সহায়তায় একটি নৌকায় উঠেছেন। তাঁদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা বিপর্যস্ত ও ক্ষুধার্ত। তাঁরা বাদাম, শুকনা খাবার ও পানি খাচ্ছেন।

৬৫ বছর বয়সী মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘এখন আমরা খুব খুশি। আমরা নিরাপদ।’

শুক্রবার আকাশ অন্ধকার করে সন্ধ্যা নেমে আসছে। রাতেও চলছে উদ্ধার অভিযান। চেষ্টা, যত দ্রুত সম্ভব আটকে পড়া দুর্গতদের কাছে পৌঁছানো এবং তাদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা।

দুর্গতদের জন্য একটাই আশার আলো, সারা দেশ থেকে মানুষ তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন।