জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি দাঁত-নখহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। গত ১৫ বছরে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটলেও তাদের এ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে অনেক ধরনের অন্যায় হলেও তারা এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। দেশে এখনো নানাভাবে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কিন্তু কমিশনকে এখনো কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
আজ বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপির সহযোগিতায় ডেইলি স্টার এ বৈঠকের আয়োজন করে। ‘একটি বিশ্বাসযোগ্য মানবাধিকার কমিশনের জন্য করণীয়: বিষয় এবং সংস্কারের পথ’ শীর্ষক ওই বৈঠকে দেশের মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন। বক্তারা প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, এখনো মানবাধিকার কমিশনকে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, এই কমিশন ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হলেও এখন পর্যন্ত এর কোনো বিধিমালা হয়নি। প্যারিস ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে তৈরি করা হলেও ওই ঘোষণায় বলা হয়েছিল, এটি যাতে সরকার থেকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু সরকারের সাবেক তিনজন সচিবকে এর চেয়ারম্যান করা হয়েছে, যা প্যারিস ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মূলত আমলানির্ভর ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ব্যয়ের ২৫ শতাংশ সরকার থেকে দেওয়া হয়, বাকি অর্থ উন্নয়ন সহযোগীরা দেয়। এ ধরনের নির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠানটিকে কখনো স্বাধীনভাবে গড়ে উঠতে দেয়নি।
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, দেশে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন নারীরা। তাঁরা ঘরে-বাইরে সবখানে নির্যাতনের শিকার হলেও তা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয় না। এই কমিশনের সংস্কারের ক্ষেত্রে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশন তৈরি হয়েছিল বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য যে আমাদের একটি কমিশন আছে। একে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করার ব্যাপারে কখনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, ওই সময়ে দেশে হাজারের বেশি মানুষ মারা গেল। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নিলেন না। তিনি বিটিভিতে আগুন লাগার পর তা দেখতে গেলেন। এ ধরনের চেয়ারম্যান যাতে আর সামনের দিনে না হয়। এই কমিশনের চেয়ারম্যানদের মানবাধিকার বিষয়ে দক্ষতা ও শিক্ষা থাকতে হবে।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সরকারের সচিব, আইনজীবী বা অধ্যাপক অনেককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। দেশে এত দিন আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু এখনো প্রথম আলো, ডেইলি স্টার–এর সামনে গরু এনে, আগুন জ্বালিয়ে এবং সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। কমিশনার হিসেবে যাকেই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, তাঁকে অবশ্যই কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।’
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ের প্রতিটি ঘটনায় মানবাধিকার কমিশন থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচারে গুলি এবং আবু সাঈদ ও মুগ্ধের মৃত্যুর পর কমিশন থেকে তার তদন্ত চাওয়া হয়েছে। তবে ওই প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে।
ইউএনডিপি বাংলাদেশের অ্যাসিস্ট্যান্ট রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ আনোয়ারুল হক বলেন, প্রথমত, মানবাধিকার কমিশনকে অবশ্যই জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। দ্বিতীয়ত, এর আইনি কাঠামোর পরিবর্তন আনতে হবে। তৃতীয়ত, এর কার্যক্রমকে শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ না রেখে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। সামগ্রিকভাবে দেশে মানবাধিকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী শিরীন পারভিন হক বলেন, ‘কমিশনকে কার্যকর করতে হলে আমাদের অবশ্যই এর চেয়ারম্যান ও জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে। বাংলাদেশের ওই কমিশন এখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বি ক্যাটাগরিতে আছে। একে এ ক্যাটাগরিতে নিয়ে আসতে হলে আমাদের এর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’
ডেইলি স্টার–এর বিশেষ সংখ্যা ও গোলটেবিল সমন্বয়কারী তানজিব ফেরদৌসের সঞ্চালনায় বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী তামান্না সিং বারাইক, সাবিনা রবিদাস, সুমাইয়া খান, নিরুপা দেওয়ান ও মহিউদ্দিন দানেশ। তাঁরা দেশের ধর্ম, বর্ণ, পেশাসহ সব ধরনের জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে কমিশনকে সোচ্চার ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।