রাজশাহী মেডিকেল কলেজ চত্বরে ব্যাপক সমাগম। এক পাশে দুবারের এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিতকে ঘিরে ছবি তোলায় ব্যস্ত অনেকে। সবার মধ্যমণি হয়ে আরেক জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন সদ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক। এসব জটলার মধ্যেই একের পর এক স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে দিচ্ছিলেন রাজশাহীর সন্তান বিশ্ব পরিব্রাজক তারেক অণু।
‘ট্যুর মুরল্যান্ড, বাংলাদেশ’ নামের ভ্রমণপ্রিয় সংগঠনটির এক যুগ পূর্তিতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কাইছার রহমান চৌধুরী মিলনায়তনে জড়ো হয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের বেশির ভাগই গতকাল শুক্রবার রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীতে এসেছেন। ইনাম আল হকসহ অনেকেই কয়েক দিন ধরে রাজশাহী ঘুরছেন।
পরিব্রাজক মানুষের সঙ্গে দেখা করতে ও তাঁদের কথা শুনতে শনিবার সকাল ৯টার মধ্যে চলে আসেন অনেকে। ১০টার দিকে শুরু হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে কেউ কেউ মূল ব্যানারের সামনে হইহুল্লোড় করলেন। নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে মিলনায়তনের পাশেই এক যুগ পূর্তির কেক কাটা হয়। তার ঠিক আগমুহূর্তে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে উদ্বোধন করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ নওশাদ আলী।
মিলনায়তনে চলতে থাকে একের পর এক ভ্রমণের গল্প। ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে উঠে এল মনুষ্য শরীর-স্বাস্থ্যসহ পৃথিবীর পরিবেশ-স্বাস্থ্য নিয়ে নানা কথা, নানা উৎকণ্ঠা। কে কীভাবে ভ্রমণপ্রিয় হয়ে উঠলেন, চ্যালেঞ্জ কেমন, কেন জীবনে ভ্রমণ দরকার—সেসবও উঠে এল। প্রত্যেকের বক্তব্য শেষে বললেন, পৃথিবীটা বাঁচাতে হবে, পৃথিবী ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
একে একে ভ্রমণ ও জীবনের কথা বলেন দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের কারিগর সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম; পর্বতারোহী, আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্র গবেষক মীর শামছুল আলম (বাবু); পর্বতারোহী, লেখক ও সম্পাদক সালেহীন আরশাদী; পর্বতারোহী ও প্রশিক্ষক ইকরামুল হাসান (শাকিল); পর্বতারোহী ও প্রশিক্ষক মো. মহিউদ্দিন; পর্বতারোহী ও সাইক্লিস্ট বাবর আলী; পর্বতারোহী ও প্রকৌশলী কাওছার রূপক; পর্বতারোহী ও লেখক আ ন ম জাফর সাদেক; মোটরসাইক্লিস্ট আবদুল মোমেন; বাংলা চ্যানেল বিজয়ী আয়রনম্যান সাকলাইন রাসেল; ভ্রমণকন্যা ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের সভাপতি সাকিয়া হক; আলোকচিত্রী ও ভ্রমণ লেখক কালপুরুষ অপু; সাঁতারু ও বাংলা চ্যানেল বিজয়ী মো. জ্যানজিবুল তারেক; ট্রেকার ও ট্রাভেলারের প্রতিষ্ঠাতা মো. নিজাম উদ্দিন; মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইন।
শুরুতে ট্যুর মুরল্যান্ডের সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমান স্বাগত বক্তব্য দেন। তাঁদের বানানো ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। জানানো হয়, সংগঠনটি ২০১১ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন সদস্যসংখ্যা ছিল ৯। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ জনে। সংগঠনটি বাইরের দেশে তিনটি ভ্রমণসহ মোট ৩৬টি ভ্রমণ করেছে।
এরপরই মঞ্চে আসেন ইনাম আল হক। তিনি এক মিনিটের বেশি বলবেন না ভেবেছিলেন। কিন্তু ১০ মিনিট বলে ফেললেন। ভ্রমণ নিয়ে নানা কথার ফাঁকে তাঁর বক্তব্যে একরকম উপদেশই এল। তিনি বললেন, ‘ভ্রমণের একটি অসুবিধা হলো, যেখানে যাওয়া হয়, সেই জায়গার স্থাপনাসহ নানা কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণী-উদ্ভিদসহ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু ক্ষতি না হলেও আমি পাহাড়ে গেলে আমার পোশাক দেখে একটা মানুষ প্রভাবিত হতে পারে। সে জন্য আমি সেখানকার উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের জন্য কিছু একটা করে যাব।’
বাংলা চ্যানেল বিজয়ী সাকলাইন রাসেল বললেন, কীভাবে তিনি বাংলা চ্যানেল জয় করলেন। তাঁর শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা তিনি দিলেন। পর্বতারোহী মীর শামছুল আলম বললেন, ‘ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে। নিজের ভুল, অক্ষমতা, কষ্ট-বেদনা–আনন্দ সবকিছু বুঝতে পারে। নিজেকে আবিষ্কার করাটা ভ্রমণ।’ পর্বতারোহী বাবর আলী বললেন, তিনি কীভাবে পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করতে সক্ষম হয়েছেন। একই সঙ্গে কাশ্মীরে সাইকেল নিয়ে ভ্রমণ করতে গিয়ে তিনি যে সাইকেল মেকানিকের দোকানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেছেন, সে কথাও বলেন।
মনোচিকিৎসক মামুন হুসাইন বললেন, ‘আজকের অনুষ্ঠানের আনন্দ, অজস্র মানুষের মুখ দেখা হলো। আমি মনে করি, মানুষের মুখ দেখা তীর্থের মতো। সেই আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক।’ রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী রাগিব নিহাল সকাল ৯টার পরই ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের কথা শুনতে চলে যান। বেলা সাড়ে ৩টায় শেষ হয় আয়োজন। রাগিব নিহাল বললেন, ‘আজকের বক্তাদের কথা শুনে মনের মধ্যে ভ্রমণের প্রতিচ্ছবি জায়গা করে নিল।’