২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

টিকিট কাটা জটিল বানিয়ে কী পাবে রেলওয়ে

টিকিট কাটার কাউন্টারের লাইনে যাত্রীরা
ফাইল ছবি

ট্রেনের যাত্রী ও মালামালের সার্বিক নিরাপত্তা এবং ভালো-মন্দ দেখার জন্য আছে রেলওয়ে পুলিশ। রয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী। ঈদ-পার্বণে চাপ বাড়লে র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যুক্ত হয়। এরপরও ট্রেনের টিকিটে কালোবাজারি চলে।

এবার কালোবাজারি বন্ধে টিকিট কেনার ক্ষেত্রে যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে। এতে কালোবাজারি বন্ধ হবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে এর মাধ্যমে অনেক যাত্রীই ট্রেনে চড়ার অধিকার হারাবেন। যাত্রীদের  হয়রানি ও কষ্ট বাড়বে।  

নতুন নিয়ম কী

নতুন নিয়ম হচ্ছে—আগে থেকে যাদের নিবন্ধন করা আছে, তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে সাইন ইন করতে হবে। এরপর জন্ম নিবন্ধন সনদ আপলোড করে নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে। আর যাদের আগে থেকে নিবন্ধন করা নেই, তাদের প্রথমে ওয়েবসাইটে সাইন আপ করতে হবে। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্র আপলোড করে পুনরায় নিবন্ধন করতে হবে। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা বাবা/মা এর জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা নিজের জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। এ ছাড়া চাইলে মোবাইল নম্বর থেকে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়েও নিবন্ধন করা যাবে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই কেবল অনলাইনে, অ্যাপে কিংবা কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা যাবে।

এতসব আয়োজনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে টিকিট কালোবাজারি বন্ধ। সাম্প্রতিক সময় ‘জো বাইডেন’ ও ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’সহ বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে নিবন্ধন করে টিকিট কাটা হয়েছে বলে রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এতে রেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। জাতীয় পরিচয় বাধ্যতামূলক করা হলে এগুলো রোধ করা যাবে। নতুন এই ব্যবস্থার ইতিবাচক দিক এর চেয়ে বেশি বলতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু যে যাত্রীদের জন্য কালোবাজারি বন্ধের উদ্যোগ, সেই যাত্রীদের হয়রানিই বেড়ে গেল। এমনকি নতুন নিয়মের কারণে দেশের কোনো কোনো নাগরিকের পক্ষে এই সেবা নেওয়াও সম্ভব হবে না। অর্থাৎ তাঁরা ট্রেন ভ্রমণ থেকে বঞ্চিত হবে। আর যারা নেবেন, তাদের কাউকে কাউকে পকেটের বাড়তি টাকাও খরচ করতে হতে পারে।

গতকাল বুধবার রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন রেলভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, যাত্রী সাধারণের সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ শীর্ষক স্লোগানকে সামনে রেখে এবং বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থায় এই পরিবর্তন। তিনি বলেন, গত দশ বছরে রেলে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়লেও টিকিট কালোবাজারিরা সব অর্জন নষ্ট করে দিচ্ছে। বদনাম হচ্ছে এ সেবা খাতের। এ জন্যেই নতুন নিয়ম চালু করতে যাচ্ছেন।
এই ব্যবস্থায় একটি এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধন নম্বরের বিপরীতে ৪টি টিকিট সংগ্রহ করা যাবে। একটি নম্বর দিয়ে প্রতিদিন একবারই টিকিট সংগ্রহ করা যাবে।

আরও পড়ুন

যাত্রীরা যেসব জটিলতায় পড়তে পারেন

রেলমন্ত্রী সেবা বাড়ানোর কথা বললেও যাত্রীদের জন্য আসলে টিকিট কেনার প্রক্রিয়াটি জটিলই করে দেওয়া হচ্ছে। সংবিধানের সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিষয়টি যদি আমলে নেওয়া হয়, তাহলে দেশের যে কোনো নাগরিকের যে  কোনো সময়ে ট্রেনে চড়ার অধিকার রয়েছে। আর এই অধিকার বাস্তবায়ন করতে হলে ১২ বছরের বেশি বয়সী দেশের জনসংখ্যার সবাইকে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের পর ওয়েবসাইট থেকে টিকিট কাটতে হলে অন্তত একটি ই-মেইল আইডি লাগবে। কারণ, ইমেইল আইডি দিয়ে সাইন আপ ছাড়া নিবন্ধন কিংবা টিকিট কাটা যাবে না। আর যারা কাউন্টার থেকে টিকিট কাটবেন, তাদেরও আগে থেকে নিবন্ধন থাকতে হবে। এই বিবেচনায় দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী টিকিট কাটার সুযোগই পাবেন না।

ধরে নেওয়া যাক, একজন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল ফোন আছে। তাঁর অনলাইনে সাইন ইন কিংবা সাইন আপ করার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে। এরপর নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনও কী সবার পক্ষে করা সম্ভব? এখন মানুষ পাসপোর্ট, ভিসা কিংবা অন্যান্য কাজে দৌড়াচ্ছে পাড়ার  দোকানে। এই সেবার জন্য নেওয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

আর মোবাইল ফোনে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নিজের টাকা খরচ করে এসএমএস করতে হবে। এ ব্যবস্থায় শুধু কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা যাবে। অনলাইন কিংবা অ্যাপের মাধ্যমে কাটা যাবে না। বর্তমানে রেলের অর্ধেক টিকিট অনলাইন ও অ্যাপে বিক্রি করা হয়। বাকি অর্ধেক কাউন্টার থেকে পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে সব টিকিট অনলাইন ও অ্যাপের মাধ্যমে বিক্রির একটা চেষ্টা আছে রেলে। গত দুই বছর ধরে এই বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে এখনো তা কার্যকর করা হয়নি।

আরও পড়ুন

রেলের কর্মকর্তারা যা বলছেন

বিষয়টি যেহেতু উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে হচ্ছে, তাই রেলের কর্মকর্তারা পরিচয় প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে চাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রেলওয়ের কর্মকর্তা একটি উদাহরণ দিয়ে এই ব্যবস্থার জটিল দিক বর্ণনা করলেন এভাবে, ধরেন একজন ব্যক্তির বাড়ি বরগুনার প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে। যিনি জীবনে কোনো দিন ট্রেনে চড়েননি। তাঁর কোনো মোবাইল নম্বর নেই কিংবা ইমেইল আইডি নেই। জরুরি কাজে ঢাকায় এসে তাঁর চট্টগ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন হলো। তিনি কীভাবে টিকিট কাটবেন, এর কোনো সমাধান নেই নতুন নিয়মে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, কারও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে কিংবা হারিয়ে গেলে ওই ব্যক্তির পক্ষে টিকিট কেটে ট্রেনে যাতায়াতের সুযোগ থাকবে না। কেউ অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে টিকিট কাটলে ওই ব্যক্তির নাম টিকিটে লেখা থাকবে। এটাকে বেআইনি হিসেবে গণ্য করবে রেলওয়ে। এ ক্ষেত্রে তাঁকে জরিমানা করতে পারবে রেলওয়ে।

অর্থাৎ ট্রেনে চড়তে হলে যাত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম নিবন্ধন সনদ, ইমেইল আইডি, মোবাইল ফোন কিংবা পাসপোর্টের কোনো একটা থাকতে হবে। এসব থাকার সনদের একটা কপি পকেটে নিয়ে ঘুরতে হবে। নতুবা যাত্রীর প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র থাকলেও চলবে। এসব সনদ বা কার্ডের সঙ্গে টিকিটে থাকা নামের মিল না পেলে অবৈধ বিবেচনা করা হবে।

আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপে অনলাইনে, বিভিন্ন অ্যাপে এবং কাউন্টারে টিকিট কাটা যায়। সেখানে কাউকে ব্যক্তিগত কোনো তথ্য দিতে হয় না। বিশেষ করে কাউন্টারে কিংবা ভেন্ডিং মেশিন থেকে টিকিট কাটার ক্ষেত্রে শুধু দাম পরিশোধ করলেই চলে। ইউরোপের দেশগুলোতে শিক্ষিত নাগরিকের হার বেশি। প্রযুক্তিও উন্নত। কিন্তু তাঁরা টিকিট কাটার ক্ষেত্রে এত জটিলতায় না গিয়ে সহজ করছে। আর বাংলাদেশ জটিল করছে। এর পেছনে কোনো গোষ্ঠীর ব্যবসা আছে কি না এই সন্দেহও করছেন ওই কর্মকর্তা।

একজন কর্মকর্তা বলেন, ছাড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে অনলাইনে টিকিট উধাও হয়ে যাচ্ছে। কাউন্টারেও টিকিট পাওয়া যায় না । ট্রেনের ভেতর নোংরা। সেবা বলতে কিছু নেই। এসবে মনোযোগ কম রেলের। লোক দেখানো উদ্যোগ বেশি।  

যেভাবে তথ্য যাচাই হবে

জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করবে রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন (যৌথ)। তারা প্রথমে তথ্য নিয়ে রেলওয়ের ওয়েবসাইটে জমা করবে। সেখান থেকে নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডার দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের সঠিকতা যাচাই করা হবে। এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রেলের একটি চুক্তি হয়েছে। এর বিনিময়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রতি বছর পাঁচ লাখ টাকা দেবে রেলওয়ে।

টিকিট বিক্রির চুক্তির অংশ হিসেবে সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেলওয়েকে পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিন বা পজ মেশিন দেবে। এই মেশিন নিয়ে টিকিটে যাত্রীর নাম ও সনদ মিল আছে কিনা তা পরীক্ষা করবেন রেলের কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন ধরে ট্রেন টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) এর বিরুদ্ধে টিকিটবিহীন যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে। এবার হয়তো অন্য একজনের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কেটে ভ্রমণের সময় ঘুষ দিয়ে ছাড়া পেতে হবে যাত্রীদের। এটা আরেকটি ঘুষের উৎসে পরিণত হয় কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুলিশ আরএনবির কাজ কী?

রেলের যাত্রী ও মালামালের নিরাপত্তা এবং টিকিট কালোবাজারিসহ সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের একটা অংশ এই দায়িত্বপালন করে। তবে তাদের বেতন-ভাতা হয় রেলওয়ে থেকে। এটাকে রেল দীর্ঘদিন ধরে বাড়তি ব্যয় হিসেবে দেখে আসছে।

রেলওয়েকে পুলিশকে ছয়টি জেলায় ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর, পাকশী ও খুলনা। দেশে রেলওয়ে থানা ২৪টি এবং রেলওয়ে ফাঁড়ি ৩৩টি। সব মিলিয়ে রেলওয়ে পুলিশের জনবল ২ হাজার ৪৩২ জন।

এর বাইরে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) রয়েছে। এর সদস্যদের নিয়োগ, বেতন-ভাতা ও অবসর সুবিধাসহ সবই বহন করে রেলওয়ে। আরএনবির সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো।

দেশের ৬৪ প্রশাসনিক জেলার মধ্যে ৪৩টিতে রেলওয়ের নেটওয়ার্ক আছে। সারা দেশে রেলপথের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার। রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে প্রায় ২৫ হাজার। পুলিশ ও আরএনবি মিলে আরও নিরাপত্তায় নিয়োজিত আরও প্রায় সাড়ে সাত হাজার সদস্য। এর বাইরে ঈদ বা পার্বণে রাষ্ট্রের অন্যান্য বাহিনীও যোগ হয়। এত কিছুর পরও কালোবাজারি বন্ধ করতে না পারা কার ব্যর্থতা? এটি কী রেলওয়ে কোনো দিন ভেবে দেখেছে? কালোবাজারি বন্ধে যাত্রীদের টিকিট কাটার পদ্ধতি দিন দিন জটিল ও কঠিন করার মাধ্যমে কী অর্জন করতে চায়?