নকশিকাঁথা আর স্বপ্ন—দুটিই একসঙ্গে বুনছেন রোকেয়া খাতুন
বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুর। শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের গাংনী উপজেলার ধানখোলা ইউনিয়নের গাড়াডোব গ্রাম। গাছগাছালি আর প্রকৃতির মায়ায় সাজানো গ্রামের মানুষগুলো অনেক বেশি হাস্যোজ্জ্বল। সঙ্গে রয়েছে বাসিন্দাদের নতুন কিছু করার অদম্য ইচ্ছা। পুরুষদের মধ্যে বেশির ভাগই কৃষক। নারীরা সংসারের ব্যস্ততা সামলেও বিভিন্ন হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত, যার মধ্যে অন্যতম নকশিকাঁথা। তেমনই একজন মোছাম্মৎ রোকেয়া খাতুন। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন তিনি। ১৩ সদস্যের যৌথ পরিবারে থাকেন রোকেয়া। তাঁর স্বামী পার্শ্ববর্তী জেলা কুষ্টিয়ায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
সংসারের নানা ব্যস্ততার মধ্যেও নকশিকাঁথা সেলাই করেন রোকেয়া খাতুন। তবে নিজের জন্য নয়, গ্রামের অসহায় নারীদের জন্যই নিরলস এ কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। কয়েক বছর আগে গাড়াডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তরিফা আক্তারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এ উদ্যোগে।
তরিফা আক্তারের এ কাজ শুরুর পেছনে রয়েছে অন্য রকম এক গল্প। তিনি যখন দেখলেন দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত ও বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে, তখন তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন। জানতে পারলেন, অনেক অভিভাবকেরই আয়ের কোনো উৎস নেই। তাই সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছেন না। স্কুলশিক্ষক তরিফা আক্তার তখন বের করলেন এক অভিনব উদ্যোগ।
অভিভাবকদের নিয়ে শুরু করলেন নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজ। সেই সময় নকশিকাঁথার ব্যাপক চাহিদাও ছিল। শিক্ষকের এ উদ্যোগে কাজ হলো, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি ও ঝরে পড়ার হার কিছুটা কমে গেল। এ কাজেই যুক্ত ছিলেন রোকেয়া খাতুন। নকশিকাঁথা সেলাইয়ের পূর্বাভিজ্ঞতা থাকায় স্কুলশিক্ষক তরিফা তাঁর মতো অনেককেই নিয়েছিলেন সেই উদ্যোগের সঙ্গে। এই দলের সদস্য ফারহানা সুলতানা ও ফারজানা আক্তার নকশা করেন, রোকেয়া খাতুনের দায়িত্ব কাঁথা সেলাই করা আর কাজ এনে দেওয়া।
পরবর্তী সময়ে তরিফা যখন ব্যক্তিগত কারণে অন্য জেলায় চলে যান, এ উদ্যোগের নেতৃত্ব আসে রোকেয়ার ওপর। উদ্দেশ্য একটাই, নিজের গ্রামের অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানো। ফলে ১০০ জনের মতো গ্রামীণ নারী রয়েছেন তাঁর সঙ্গে। পরিচিতজন ও আশপাশের খুচরা বিক্রেতারাই রোকেয়াদের সেলাই করা নকশিকাঁথার গ্রাহক।
রোকেয়া বলেন, ‘সংসারের নানা ব্যস্ততা সামলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে পুঁজি করে এ উদ্যোগকে সমৃদ্ধ করার স্বপ্ন দেখছি। যদি কোনো প্ল্যাটফর্ম থাকত, খুব ভালো হতো। তাহলে এখানকার সব নারী সব সময় কাজের সুযোগ পেত। আমার ইচ্ছা এটা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও পরিকল্পিতভাবে কাজ করার। আমার গ্রামের নারীদের জন্য কিছু করতে পারব—এটা ভেবেই ভীষণ আনন্দ লাগছে।’
এভাবেই একটু একটু করে একসঙ্গে নকশিকাঁথা ও স্বপ্ন বুনছেন রোকেয়া খাতুন। তাঁর স্বপ্ন বোনায় সহযোগিতা করেছে গ্রামীণফোনের উদ্যোগে আয়োজিত উঠান বৈঠক। গত ২৯ সেপ্টেম্বর গাংনী উপজেলার ধানখোলা ইউনিয়নের আয়োজিত উঠান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়ির উঠানেই হয় এ আয়োজন। গ্রামীণ নারীদের এ বৈঠকে আসার জন্য তিনিই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘উঠান বৈঠকে সফল উদ্যোক্তাদের ভিডিও দেখে আমার নকশিকাঁথার কাজটা এগিয়ে নেওয়ার সাহস ও আত্মবিশ্বাস—দুটিই বেড়েছে। আমার সঙ্গে কাজ করেন—এমন নারীরাও এখানে অংশ নিয়েছিলেন। আমি তাঁদের চোখে-মুখেও কিছু করার প্রত্যয় দেখেছি।’
রোকেয়া খাতুনের মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারীর বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করতে সাহস ও উৎসাহ জোগানোর প্রচারাভিযানের নাম ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’। লক্ষ্য, ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা যাতে জীবনের চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারেন। এ উদ্যোগের মাধ্যমে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে উঠান বৈঠক। সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি।