রাশিয়া ও চীনের আদলে এক্সে বাংলাদেশ নিয়ে ছড়ানো হচ্ছে অপতথ্য
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন এবং এখানে ইসলামি শাসন কায়েম ও নিপীড়ন শুরু হয়েছে—সংগঠিতভাবে এমন নানা অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার)। অপতথ্য ছড়ানোর জন্য খোলা হয়েছে নতুন নতুন অ্যাকাউন্টও।
এদিকে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক্স প্ল্যাটফর্মে এভাবে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হচ্ছে রাশিয়া ও চীনের কৌশল।
প্রযুক্তিগত অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর ‘দ্য অ্যানাটমি অব ডিজইনফরমেশন অন এক্স’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
অ্যাকাউন্টগুলো ভারতভিত্তিক বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবহারকারী এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অ-ভারতীয়দের লক্ষ্য করে পোস্ট দিয়ে থাকে। এক্সে বাংলাদেশকে নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর এসব অ্যাকাউন্ট রাশিয়া, ইসরায়েল ও চীনের ট্রল ফার্ম এবং কি–বোর্ড আর্মিজের (অর্থের বিনিময়ে নিয়োগকর্তা বা সামাজিক যোগাযোমাধ্যম প্ল্যাটফর্মের স্বার্থরক্ষাকারী গোষ্ঠী) কৌশল অনুসরণ করে সমন্বিতভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে বিদেশে তথ্যের কারসাজি–সম্পর্কিত বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। যেমন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরিতে এক্স ব্যবহারকারীরা কীভাবে অপতথ্য ছড়াচ্ছেন, তা দেখানো হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
গবেষণায় গত ২৬ জুলাই থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে এক্সে মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিবিষয়ক পোস্ট থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে এক হাজারের বেশি বিষয়বস্তু সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে ১০০টি একক ‘ডেটাসেট’ (সংগঠিত ও সংরক্ষিত তথ্য–উপাত্তের কাঠামোগত সংগ্রহ) পেয়েছে টেক গ্লোবাল, যেখানে বিকৃত তথ্য প্রচার করা হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতার যথেষ্ট ঝুঁকি তৈরি করে—এমন উপাদান রয়েছে এসব তথ্যে। এ ডেটাসেট বিশ্লেষণ করেই প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।
টেক গ্লোবাল বলেছে, অপতথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে মেটার থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেক রেটিং ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়; যদিও এ পদ্ধতি এক্স বা ইউটিউবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না–ও হতে পারে।
বেশি অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে নভেম্বরে
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপতথ্যগুলোর ৭৭ শতাংশই এক্সে পাওয়া গেছে। ৩৫ শতাংশ অপতথ্য এক্স, ফেসবুক ও ইউটিউবে একসঙ্গে পোস্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭১ শতাংশ কনটেন্ট (আধেয়) বার্তা আদান–প্রদানের প্ল্যাটফর্ম ভাইবার, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে নভেম্বর মাসে। এরপর আছে আগস্ট। এ দুই মাসে এক্সে নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরির ঊর্ধ্বগতিও দেখা গেছে, যেগুলো বিভ্রান্তি ছড়ানোর সঙ্গে যুক্ত। শুধু অক্টোবর থেকে নভেম্বরে বেড়েছে ২১৪ শতাংশ নতুন অ্যাকাউন্ট। এর মধ্যে অনেক অ্যাকাউন্টই ভেরিফায়েড।
এ অ্যাকাউন্টগুলো একই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে। একে অন্যের পোস্ট রিপোস্টও করে। এমনকি তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্টচেকারদের কাছে এগুলো বারবার অপতথ্য ছড়ানোয় যুক্ত অ্যাকাউন্ট হিসেবেও চিহ্নিত। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের কাজ সংগঠিত নেটওয়ার্কভুক্ত গোষ্ঠীর বলে ধারণা দেয়।
এ অ্যাকাউন্টগুলোর ৭৪ শতাংশ ভুল তথ্যসংবলিত পোস্ট করেছে। অপ্রাসঙ্গিক তথ্য প্রকাশ করেছে ২৪ শতাংশ। আর পরিবর্তন ও সহিংসতার ডাক দেওয়া পোস্ট ছিল ১ শতাংশ।
১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য প্রচার
এসব পোস্টের শীর্ষ হ্যাশট্যাগের মধ্যে রয়েছে, #সেভহিন্দুসইনবাংলাদেশ, #বাংলাদেশিহিন্দুজেনোসাইড। এই হ্যাশট্যাগের সঙ্গে থাকা কনটেন্টগুলোর বেশির ভাগই ভুয়া।
অপতথ্যের অন্যতম বিষয়বস্তু ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য বা আক্রমণ’
বিশ্লেষণ বলছে, পোস্ট করা অপতথ্যের বিষয়বস্তুর একটি এমন, ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের গণহত্যা চলছে’। এটি মোট অপতথ্যের প্রায় ২৭ শতাংশ। এ ছাড়া সাম্প্রদায়িক বিষয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপনের পরিমাণ ২১ শতাংশ। শেয়ার করা কনটেন্টের অন্যতম বিষয়, ‘ধর্মের কারণে হিন্দুরা বৈষম্য বা আক্রমণের মুখে পড়ছে’।
টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট বলছে, তারা অ্যাকাউন্টগুলোর উৎপত্তি বোঝার জন্য কিছু সংকেত বিশ্লেষণ করেছে। এতে দেখা যায়, এগুলো সম্ভবত বাংলাদেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হচ্ছে বা তাদের বিষয়বস্তুগুলো ভারতীয় অতি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। এসব অপতথ্য ভারত ও ভারতের বাইরের ব্যবহারকারীদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে।
কিছু সংকেতের মধ্যে রয়েছে ভারতীয় ডানপন্থী বা অতি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ উদ্বুদ্ধ করে—এমন কনটেন্ট। ভারতের ডানপন্থী গণমাধ্যম, যেমন রিপাবলিক বাংলা বা অপইন্ডিয়া থেকে শেয়ার করা বিষয়বস্তু বা সরাসরি উদ্ধৃতি, যেখানে হিন্দি ভাষার ব্যবহার বেশি, বিশেষ করে প্রোফাইল, কমেন্ট ও পোস্টে। এসব পোস্টে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের ট্যাগ করা হয়। আরও কিছু সংকেতের মধ্যে আছে, নির্দিষ্ট কোনো পোস্টের প্রসার বাড়ানোর সমন্বিত উদ্যোগ, একই হ্যাশট্যাগের ব্যবহার, ভারতের অতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ।
অপতথ্য ছড়াতে নানা কৌশল
টেক গ্লোবাল বলছে, অ্যাকাউন্টগুলো ভারতভিত্তিক বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবহারকারী এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অ–ভারতীয়দের লক্ষ্য করে পোস্ট দিয়ে থাকে। এক্সে বাংলাদেশকে নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর এসব অ্যাকাউন্ট রাশিয়া, ইসরায়েল ও চীনের ট্রল ফার্ম ও কি–বোর্ড আর্মিজের (আর্থিক বা অন্য সুবিধার বিনিময়ে নিয়োগকর্তা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মের স্বার্থ রক্ষাকারী গোষ্ঠী) কৌশল অনুসরণ করে সমন্বিতভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে।
এ কায়দায় সমন্বিত প্রচারের কিছু কৌশলের উদাহরণ দিয়েছে টেক গ্লোবাল। যেমন গত অক্টোবরে ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শ্রেণিকক্ষে লাঠি হাতে এক যুবকের ঢুকে পড়ার ঘটনায় একাধিক এক্স অ্যাকাউন্ট ভিডিও পোস্ট করে লিখেছে, ‘বাংলাদেশে শরিয়াহ আইন চালু, ক্লাসে ঢুকে সহিংস ইসলামপন্থীরা নিপীড়ন করছে।’ একই ঘটনায় একটি অ্যাকাউন্ট লিখেছে, ‘বাংলাদেশের তালেবানীকরণ।’
গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকারদের বরাতে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় জড়িত যুবক মানসিকভাবে অসুস্থ এবং তিনি কোনো ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত নন।
আরেকটি কৌশল হিসেবে বলা হয়েছে, রাশিয়ার ট্রল ফার্মের কৌশল অনুকরণ করে ‘হিন্দুদের বিরুদ্ধে হত্যা ও সহিংসতা’ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত তথ্যের উপস্থাপন। যেমন অপইন্ডিয়া গত ৫ নভেম্বর একটি পোস্ট করে বলে, ‘চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে হিন্দুরা আক্রমণের শিকার।’ বাবা বানারস নামের আরেকটি অ্যাকাউন্ট থেকে করা পোস্টে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থীদের আক্রমণে ৫০ জন হিন্দু মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন।’ প্রায় একই রকম তথ্য দিয়ে আরও কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়।
তবে এ নিয়ে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকাররা বলেছে, চট্টগ্রামে একটি প্রতিবাদ সভা হয়েছিল, কিন্তু কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
এ ছাড়া আরও একটি অ্যাকাউন্ট থেকে দাবি করা হয়, ‘শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে ২৭ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে।’
সুইডেনভিত্তিক গণমাধ্যম নেত্র নিউজের একটি প্রতিবেদনের তথ্য দিয়ে টেক গ্লোবাল বলেছে, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করেছে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ৯ জন হিন্দু মারা গেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনার প্রমাণের অভাব ছিল। ঘটনাগুলো ছিল মূলত পারিবারিক বিরোধ, রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা অপরাধমূলক হত্যার সঙ্গে যুক্ত। এসবের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কোনো সম্পর্ক নেই।
এ ছাড়া ওই সব অ্যাকাউন্টের ব্যবহারকারীরা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্ক রয়েছে দাবি করে ডিপফেক কনটেন্ট ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে কাজে লাগাতে এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যকে বৈধতা দিতে ভারতের মূলধারার মিডিয়াকে ব্যবহারের কৌশলও নিয়েছে।
টেক গ্লোবাল বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে অপতথ্য বৃদ্ধির সঙ্গে বিদেশিদের জড়িত থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক। যদিও চীন, ইরান, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলোর অপতথ্যের ক্যাম্পেইনের তুলনায় বাংলাদেশের ঘটনা ছোট। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব অপতথ্যের ব্যাধি কার্যকরভাবে মোকাবিলায় ভূরাজনীতি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির পর জোর দেওয়া প্রয়োজন।
গবেষণাটি সম্পর্কে জানতে চাইলে টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশীদ দিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অপতথ্য নিয়ে যে কাজগুলো হয়েছে, সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফ্যাক্টচেকিং বা দেশীয় নেটওয়ার্কের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তাই এখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপতথ্য প্রচারণা অনেক বড় পরিসরে মনে হলেও এটি বিশ্বব্যাপী অন্যান্য বৈদেশিক অপতথ্য প্রচারের তুলনায় ছোট। কিন্তু এটা বেড়ে যাওয়ার আগে এর প্রভাব সম্পূর্ণভাবে বুঝতে আমাদের বৈদেশিক অপতথ্য গবেষণায় আরও জোর দেওয়া উচিত।’
অপতথ্য মোকাবিলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, ভূরাজনৈতিক আলোচনাগুলোয় বাংলাদেশের অংশীদারত্ব বাড়ানো এবং এর পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও বেশি জবাবদিহিতার আওতায় আনা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন সাবহানাজ রশীদ।