এইচএসসিতে ‘বৈষম্যহীন’ ফলের দাবিতে সচিবালয়ে ঢুকে বিক্ষোভ, শিক্ষার্থীদের মারধর
দুই মাস আগে সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পরীক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করলে স্থগিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল শিক্ষা বিভাগ। ফলাফল প্রকাশের পর এবার এসএসসির সব বিষয় ‘ম্যাপিং’ করে নতুন করে ‘বৈষম্যহীনভাবে’ এইচএসসি পরীক্ষার ফলের দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করেছেন একদল শিক্ষার্থী।
আজ বুধবার সচিবালয়ের ভেতরে এই বিক্ষোভ ঘিরে ব্যাপক উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয় পুলিশ। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনেককে মারধর করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সচিবালয়ে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরাও শিক্ষার্থীদের মারধর করেন। এতে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এ সময় পুলিশ অন্তত ৫৩ জনকে আটক করে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানানোর জন্য শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের একাংশের এই দাবি অযৌক্তিক। এই শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকার নমনীয়তা দেখিয়ে আসছিল। কিন্তু যখন সচিবালয়ের মতো জায়গায় ঢুকে পড়েছে, তখন সরকার কঠোর হয়েছে।
এ বছরের এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখন পর্যন্ত ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা বাকি ছিল। ব্যবহারিক পরীক্ষাও বাকি ছিল। একপর্যায়ে স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে গত ২০ আগস্ট সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পরীক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। তখন স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে বাধ্য হয় শিক্ষা বিভাগ।
স্থগিত হওয়া বিষয়গুলোর পরীক্ষা আন্দোলনের মুখে বাতিলের কারণে এবার এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন হয় ভিন্ন পদ্ধতিতে। বাতিল হওয়া পরীক্ষাগুলোর মূল্যায়ন হয়েছে পরীক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে (বিষয় ম্যাপিং)। অর্থাৎ এসএসসিতে যে নম্বর পেয়েছিলেন শিক্ষার্থী, সেটা এইচএসসিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আর এইচএসসিতে যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা হয়েছিল, সেগুলোর উত্তরপত্রের ভিত্তিতে মূল্যায়ন হয়েছে। এ দুই মূল্যায়ন মিলে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করা হয়েছে।
১৫ অক্টোবর এইচএসসি-সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। এবার মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন। এর মধ্যে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮। এর মধ্যে নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন শুধু এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন ১১ লাখ ৩১ হাজার ১১৮ জন। এর মধ্যে পাসের হার ৭৫ দশমিক ৫৬।
ফলাফল প্রকাশের পর একদল শিক্ষার্থী বলে আসছেন, ইতিমধ্যে যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, তা বৈষম্যমূলক। এ জন্য এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সব বিষয়ের ওপর ‘ম্যাপিং’ করে নতুন করে ফল প্রকাশ করতে হবে। এই দাবিতে রোববার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে বিক্ষোভ করেন এসব শিক্ষার্থীর একটি অংশ। শিক্ষার্থীদের অবরোধের মুখে সেদিন চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার। সেই অনুযায়ী সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র জমাও দেন তিনি।
একই ধরনের দাবিতে আরও কয়েকটি শিক্ষা বোর্ডেও বিক্ষোভ, তালা দেওয়া, ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের অভিযোগ, সেদিন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে কর্মসূচি চলাকালে তাঁদের ওপর হামলা হয়। হামলায় কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। অন্যদিকে বোর্ডের কর্মকর্তারা বলে আসছেন, শিক্ষার্থীরা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কক্ষে, এমনকি কক্ষের সামনেও ভাঙচুর চালান।
সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই দাবি আদায়ে আজ বুধবার সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা তিনটার দিকে দেখা যায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবনের নিচে (সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবন) মূল ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি সেনাসদস্যদের দেখা যায়।
সচিবালয় রাষ্ট্রের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর (কেপিআই) একটি। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই সচিবালয় থেকে মূলত দেশ পরিচালিত হয়। তাই সচিবালয়ে ঢুকতে গেলে বিশেষ পাসের (অনুমতিপত্র) প্রয়োজন হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে যাওয়া কোনো কোনো শিক্ষার্থীকেও সচিবালয়ে দেখা গেছে। বিক্ষোভকালে একজন শিক্ষার্থী বলেন, তাঁরা এইচএসসি পরীক্ষার বৈষম্যহীন ফল চান। পাশাপাশি বিভিন্ন বোর্ডে তাঁদের ওপর যে হামলা হয়েছে, তার বিচার চান। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা এখানে অবস্থান করবেন।
এ নিয়ে সচিবালয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয় পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীদের অনেককে মারধর করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি সচিবালয়ে কর্মরত অনেকেই শিক্ষার্থীদের মারধর করেন। এতে বিক্ষোভকারীদের সচিবালয়ের ভেতরেই ছত্রভঙ্গ হয়ে এখানে-সেখানে চলে যেতে দেখা যায়। তখন সচিবালয়ের ভেতর থেকে আন্দোলনকারী অনেক শিক্ষার্থীকে আটক করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
বিকেল সোয়া চারটার দিকে সচিবালয়ে দায়িত্বরত পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় তখন পর্যন্ত আটক ব্যক্তির সংখ্যা ৫৩।
আটক ব্যক্তিদের বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে দুটি প্রিজন ভ্যানে করে সচিবালয়ের ভেতর থেকে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সচিবালয়ে বিক্ষোভের ঘটনায় আটক ব্যক্তিদের থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।