ফার্নেস তেলের চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে বিপিসি

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের সরকারি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস তেলের সংকটে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সেচ মৌসুম ও গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে ৭ মাসে ৩৫ লাখ ৫১ হাজার ৪৮ মেট্রিক টন ফার্নেস তেল চেয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সম্প্রতি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে পিডিবি। কিন্তু চাহিদার অর্ধেকও সরবরাহ করতে পারবে না জ্বালানি তেল আমদানির একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিপিসি। ফলে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেসের সংকটে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিপিসি সূত্র জানায়, গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পিডিবি চলতি বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১২ লাখ ৩৯ হাজার ২৩১ টন ফার্নেস তেলের চাহিদার কথা বিপিসিকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছিল। ওই চিঠিতে চলতি বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাহিদা ধরা হয় ৮ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯৫ টন। বিপিসি সে অনুযায়ী এই জ্বালানি আমদানির পরিকল্পনা করে। পরবর্তী সময়ে গত ৬ মার্চ আরেক চিঠিতে পিডিবি জানিয়েছে, এই বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭ মাসে প্রয়োজন হবে ৩৫ লাখ ৫১ হাজার ৪৮ টন ফার্নেস তেল, যা আগের চিঠির চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। কিন্তু চাহিদামতো ফার্নেস আমদানি ও সরবরাহ করতে পারবে না সংস্থাটি।

বছরে ৬০ লাখ থেকে ৬৫ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। এর মধ্যে রয়েছে ফার্নেস তেল। ‘হাই-সালফার ফার্নেস অয়েল’ সাধারণত কালো তেল হিসেবে পরিচিত। ছোট-বড় শিল্পকারখানায় চুল্লি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লার ও সমুদ্রগামী জাহাজে জ্বালানি হিসেবে এই তেল ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এটির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি।

জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী এই পরিমাণ ফার্নেস তেল আমদানি ও সরবরাহ করা বিপিসির পক্ষে সম্ভব নয়। বিষয়টি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে নিজেদেরই ফার্নেস আমদানি করতে হবে। তবে সাগরে বড় ট্যাংকার থেকে পাইপের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাসের প্রক্রিয়া শুরু হলে মাসে ২ লাখ ৫০ হাজার টন ফার্নেস আমদানি ও সরবরাহ করা যাবে।

বছরে ৬০ লাখ থেকে ৬৫ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। এর মধ্যে রয়েছে ফার্নেস তেল। ‘হাই-সালফার ফার্নেস অয়েল’ সাধারণত কালো তেল হিসেবে পরিচিত। ছোট-বড় শিল্পকারখানায় চুল্লি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লার ও সমুদ্রগামী জাহাজে জ্বালানি হিসেবে এই তেল ব্যবহার করা হয়।

আমদানি সক্ষমতা মাসে ১ লাখ টন

দেশে দুই ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়—পরিশোধিত ও অপরিশোধিত। বিপিসির এক চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে দুটি জেটির (ডলফিন-৫ ও ৬) মাধ্যমে নিয়মিতভাবে আমদানি করা পরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাস করা হয়। আর ডলফিন জেটি-৭-এর মাধ্যমে শুধু অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাস হয়। ফলে বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল, জেট ফুয়েল, অকটেন, মেরিন ফুয়েলের পাশাপাশি প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ১ লাখ টন ফার্নেস তেল আমদানি করা সম্ভব হতে পারে। এর বেশি সম্ভব নয়।

অবশ্য সাগরে বড় ট্যাংকার থেকে পাইপের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাসের জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছিল বিপিসি। প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকাদার নিয়োগ না দেওয়ায় এখনো জ্বালানি তেল খালাস শুরু হয়নি। বিপিসির চিঠিতে এই বিষয়ে বলা হয়েছে, পাইপে জ্বালানি তেল খালাসের কার্যক্রম শুরু হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রতি মাসে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন ফার্নেস তেল আমদানি ও সরবরাহ করা যাবে। বর্তমানে একমাত্র সরকারি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) ফার্নেস তেল মজুত করা হয়। মজুত সক্ষমতা মাত্র ১ লাখ ৫ হাজার টন।

বিপিসি সূত্র বলছে, গত বুধবার পর্যন্ত সংস্থাটির কাছে ফার্নেস তেলের প্রকৃত মজুত ছিল ৭৭ হাজার ৩৪১ টন। এই মজুতে চলবে ৪৫ দিন। গত ১ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার ৮৩৫ টন। গড় বিক্রির পরিমাণ দিনে ১ হাজার ৭২২ টন। চলতি মাসে ৫০ হাজার টন ফার্নেস তেল নিয়ে দুটি কার্গো দেশে আসার কথা রয়েছে।

বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল, জেট ফুয়েল, অকটেন, মেরিন ফুয়েলের পাশাপাশি প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ১ লাখ টন ফার্নেস তেল আমদানি করা সম্ভব হতে পারে। এর বেশি সম্ভব নয়।

আমদানি কমিয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো

বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৬৫টি। উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট। বছরে ৫০ লাখ টনের বেশি ফার্নেস তেল প্রয়োজন হয় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এর মধ্যে ৪০ লাখ  থেকে ৪২ লাখ টন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিজেরা আমদানি করত। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া, ঋণপত্র খুলতে জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে আমদানি কমিয়েছে তারা। এতে বাড়তি চাহিদা পাচ্ছে বিপিসি।

বিপিসির এক চিঠিতে বিগত তিন অর্থবছরে ফার্নেস তেল আমদানির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসি থেকে পিডিবি ৫ লাখ ৩৭ হাজার টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮ লাখ ১২ হাজার টন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ লাখ ৬৯ হাজার টন ফার্নেস তেল নিয়েছে।

অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমদানি করেছে ৪০ লাখ ৩৭ হাজার টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৮ লাখ ৪৭ হাজার টন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১০ লাখ ৮৯ হাজার টন। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে আমদানি কমেছে ৭৩ শতাংশ। এই বছরে বিপিসির কাছে চাহিদা একলাফে তিন গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

৩৫ লাখ টন ফার্নেস তেল একসঙ্গে প্রয়োজন নেই। মাসে মাসে এই তেল সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। বিপিসির কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী ফার্নেস না পেলে কিছুটা সংকট তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বিইপিপিএ সভাপতি কে এম রেজাউল হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এত দিন নিজেরা তেল আমদানি করে কেন্দ্র চালাতেন। তেল খালাসের জন্য ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ পেতেন তাঁরা। এটি সম্প্রতি কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ কারণে বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র তেল আমদানি করতে পারছে না। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে পিডিবিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বড় বড় প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে ফার্নেস আমদানি করবে। বিপদে পড়বে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা বলছেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড তেলের ব্যবস্থা করলে তাঁরা গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবেন। নয়তো উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। বাড়তে পারে লোডশেডিং।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ৩৫ লাখ টন ফার্নেস তেল একসঙ্গে প্রয়োজন নেই। মাসে মাসে এই তেল সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। বিপিসির কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী ফার্নেস না পেলে কিছুটা সংকট তৈরি হতে পারে। তবে বিপিসির বাইরেও অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র এই জ্বালানি আমদানি করে। ফলে দুটোর সমন্বয়েই সংকটের সমাধান করা হবে।